ছোটবেলা থেকেই নদীর পাশে বেড়ে উঠেছি। ভৈরব নদীর কোল ঘেঁষে কেটেছে জীবনের বারোটি বছর। মাঝে দুই বছরের জন্য নদীর সাথে বিচ্ছেদ। কিন্তু বিরহ ব্যথা স্থায়ী হলো না বেশি দিন। দুই বছর বাদেই এসে পড়েছি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। ধারণা করা যায় ভবিষ্যৎ ছয়-সাত বছরের ঠিকানা এ ব্রহ্মপুত্রই। নদীর সাথে এ আজন্ম সখ্যতার জন্য নদী আমায় কখনোই অত টানে না। যত কল্পনা সব পাহাড়-ঝর্ণা-সমুদ্রকে ঘিরে। ২৩ জুলাই,২০১৮। সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। ভ্রমণ পিপাসু মন বরাবরের মতোই ছুটে যেতে চাচ্ছে অজানাকে জানতে, অদেখাকে দেখতে। এরই মাঝে পেয়ে যাই ট্রাভেলেটসের টাঙ্গুয়ার হাওড় ইভেন্ট। কোনো চিন্তা না করেই শেষ মুহূর্তে আমি ও বান্ধবী দিশি দুটো সিট কনফার্ম করি।

হাওড় মানে কি শুধুই পানি? এমনই নানা জল্পনা-কল্পনার মাঝে অবশেষে এলো সে কাঙ্ক্ষিত দিন । ২৬ জুলাই,বৃহস্পতিবার। ময়মনসিংহ থেকে আমি ও দিশি দুপুরে বাসে উঠলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাস্তার প্রচণ্ড জ্যাম মনে ঢুকিয়ে দিল এক অজানা শঙ্কা। আদৌ পৌঁছাতে পারব তো সময়ের মধ্যে? অবশেষে ঢাকা-ময়মনসিংহ ৭ ঘণ্টা যাত্রা শেষে বাস থেকে নেমে সিএনজি তে করে যাই বাসস্ট্যান্ডে। আহ! কি শান্তি! অবশেষে বাস ছাড়ল রাত ১১ টায়। বকুল ফুলের গান, ভিতর-বাহিরে অন্তরে অন্তরে এরকম একের পর এক হৃদয় জুড়ানো গানের তালে সুর মেলাতে মেলাতে ঘড়িতে বাজলো প্রায় ২ টা। কখন যে চোখ লেগে এলো খেয়ালই হলো না। ভোরের আলো ফোঁটার পর যখন বাস জোরে ঝাঁকি খেল, তখন সম্বিত ফিরে এলো। বাহ! কোলাহলময় যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে সাক্ষাৎ মিলল এক নতুন সকালের সাথে। কিছুক্ষণ পর ৭ টা ৩০ এর দিক আমরা বাস থেকে নামলাম। এর পর লেগুনাতে চেপে বসলাম। দু’ধার অবারিত সবুজ আর তার মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলছে লেগুনা। খানিক বাদে বাদে চোখে পড়ছে ছোট ছোট বিলে লাল-সাদা শাপলা। কিছু সময় পড়েই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি।

মাঝের রাস্তা দিয়ে চলছে আমাদের লেগুনা। দু’ঘণ্টা যাত্রার পর আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। হোটেলে নেমে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নৌকায় উঠলাম। ঘণ্টাখানেক পর আপুরা বাজার সদাই করে আনার পর তপ্ত রৌদ্রের মাঝে নৌকা যাত্রা করলো। শান্ত পানিতে বয়ে চলছে নৌকা। নৌকার ছাদে উঠে অনুভব করলাম অপরিসীম সৌন্দর্য। স্বচ্ছ পানি আর পানির মাঝে মাঝে গাছ- দেখতে খুব ভালো লাগছিলো। ঘন্টা খানেক পর এমনই এক জলাবন এর পাশে মাঝি মামা নৌকা ভিড়াল। নৌকা থেকে সবাই মিলে পানিতে ঝাঁপ দিলাম। শুরু হলো মেয়েদের জলকেলি। খোলা আকাশের নিচে স্বচ্ছ পানিতে ভাসমান সবুজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে ৩৬ টি মেয়ের একসাথে পানিতে দাপাদাপির কি যে অনুভূতি- তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। ঘণ্টাখানেক পানিতে দাপাদাপি শেষে এবার ভুড়ি ভোজের পালা। হাওড়ের মাছের সে কি স্বাদ- এখনো মুখে লেগে আছে। আর মাঝি মামা ও বাবুর্চিদের রান্নার প্রশংসা না করে পারলাম না। নৌকা এগিয়ে চলছে আপন গতিতে। বিকাল হতেই কমতে থাকে রৌদ্রের তপ্ততা। দূরে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত মেঘালয়। হাওড়ের বুকে ডুবে যায় একটি জ্বলন্ত সূর্য। নৌকা ভিড়ে তীরের নিকটে। সন্ধ্যা নামতেই বহু দূরের মেঘালয়ের সোডিয়াম বাতি আমাদেরকে বরণ করে নেয়। গল্প,আড্ডা,গানেই পার হতে থাকে রাত। এরই মাঝে বৃষ্টি। আকাশে লুকোচুরি খেলা চাঁদের আলোর দেখা আর মেলে না। রাতে আরেক দফা ভুড়িভোজ শেষে সবাই মিলে ঘুমিয়ে যাই ছাউনির ভিতর। একটি কথা না বললেই নয়-হোস্ট আপুদের কাছে নৌকার বাথরুমের যে বর্ণনা শুনেছিলাম, দেখে মনে হলো কল্পনার চেয়ে এ বাথরুম ঢের ভালো। শান্তা আপু আর সিলভী আপুর ডাকাডাকিতে খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে গেলাম। শুরু হলো দ্বিতীয় সকাল। এবার যাত্রা লাক্ষাছড়া। পায়ে হেঁটে যাওয়ার এ পথটা ছিল অদ্ভুত সুন্দর। শুভ্র সকালে মেঘালয়ের পাদদেশ দিয়ে হেঁটে চলছি। যাওয়ার পথে পেয়ে গেলাম মেঘালয়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা এক ঝর্ণার সন্ধান। সেখানে গা ভিজিয়ে নিতে ভুল হলো না।
লাক্ষাছড়ায় গিয়ে দেখি বালুর স্তর, ছোট ছোট পাথর,আর পাদদেশে একটু পর পর আছড়ে পড়ছে ঠাণ্ডা পানির প্রবাহ। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে এরপর চলে গেলাম নীলাদ্রি লেকে। ছবির চেয়েও অনেক সুন্দর এই লেক। সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছে নিচে দাঁড়িয়ে পানির যে নীলাভ রং দেখেছি, টিলার উপরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ সবুজ রং।টিলায় দাঁড়িয়ে অনুভূতি হলো- ইশ,যদি ঐ মেঘালয়ে চড়ে বেড়াতে পারতাম! সকালের নাস্তা শেষে ঘুরে এলাম শিমুল বাগান। রক্ত লাল ফুলের শূন্যতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সবুজ বৃক্ষ। এর পর পাহাড়ে উঠার আশাও পূরণ হলো বারিক্কা টিলা জয়ের মাধ্যমে। হাওড়ের পানির ভিন্ন ভিন্ন রং অনুভব করতে করতে হঠাৎ করে আকাশ থেকে নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি। চারিদিকে অথৈ পানি, এর মাঝে হাওড়ের বুক চিরে বেয়ে চলা নৌকার ছাদে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে দিয়ে ঝুম বৃষ্টি উপভোগের যে অনুভূতি- এক মুহূর্তের জন্য হলেও আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন যে- জীবন সত্যিই সুন্দর। হাওড়ের মেঘ-বৃষ্টির প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম যাদুকাটা নদী। জানি না এ নদীর নামের ইতিহাস। তবে নদীর ওপারে মেঘালয়ের উপর জমে থাকা মেঘের ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমি যেন হারিয়ে যাই জাদুর রাজ্যে।

সত্যিই এ নদী তার নামের সার্থকতা বহন করে বেয়ে চলছে। এরপর আমরা নেমে যাই যাদুকাটা নদীতে। শেষবারের মতো পানিতে দাপাদাপি করে এবার তবে ফিরবার পালা।দুপুরের খাবার নৌকাতেই সেরে নিলাম। প্রতি মুহূর্তে মাঝি মামাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ না হয়ে পারছি না। যতই নৌকা বেয়ে চলছে, মেঘালয় থেকে ততই দূরে সরে যাচ্ছি। সাঁঝের বেলায় শেষবারের মতো হাওড়কে বিদায় জানিয়ে নৌকা থেকে নামলাম। দুই ঘণ্টার লেগুনা যাত্রা শেষে হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে বাসে উঠলাম। রাত ১১ টায় বাস ছাড়ল। একঘুমে সকাল হলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাস থেকে নেমে যাত্রা শুরু করলাম ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে। সাক্ষী হলো এক ঝাঁক অনুভূতি। আজও চোখ বুজলে হারিয়ে যাই আমার জীবনের স্পন্দনের সেই মুহূর্তগুলোতে। আশা করি আগামী কয়েক যুগ পরেও এ হাওড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে প্রশান্তি। হাওড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না আমাদের অসচেতনতামূলক কোনো কাজের দ্বারা। আজও নির্ভরতা খুঁজে পাই ট্রাভেলেটস নামের মাঝে- যারা সুযোগ দিয়েছে হাজারো মেয়েকে ডানা মেলে উড়তে।
নাম:মাশশারাত মালিহা
পেশা:ভেটেরিনারি অনুষদ,৩য় বর্ষ,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,
ময়মনসিংহ