স্বপ্নটা ছোটবেলার।। ঘুরে বেড়াবো সারা দেশ তার পর দুনিয়া। বাবা বুঝাতো বড় হও। দিন যায়, বড় হওয়ার ধাপগুলো পার হওয়া আমি তখনও অনুমতি পাই না ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু মন যে স্থির থাকেনা। এর মাঝেই ছোট বোনের কাছ থেকে জানি ট্রাভেলেটস এর কথা। মৈনট ঘাট ট্যুরের আগের কথা। অফিস আর নানা ঝামেলায় ছুটে গেলো মৈনট ঘাট আর কিউকারডং ভ্রমণের সুযোগ। হুট করেই চোখে পরলো সিলেট ট্যুর। পাহাড়, ঝর্ণা, নৌকায় ঘুরে বেড়ানো। তার উপর ছুটির দিন। একবারে যেনো সোনায় সোহাগা। যাওয়ার সম্ভাবনাটাকে পাকাপক্ত করে হাঁফ ছেড়ে যেনো বাঁচলাম। পরিবারের সাথে কক্সবাজার ট্যুর আর বন্ধুদের সাথে মাধবকুন্ড ঘুরে এসে নিজের একটা পছন্দ পোক্ত করতে পেরেছিলাম। সাগরের চেয়ে পাহাড় আমাকে বেশি টানে, স্রোতের চেয়ে ঝর্ণার ধারা। যখন জানলাম সিলেট ট্যুরে ঝর্ণার দর্শন থাকবে মন ছুটে গিয়েছিলো। তার উপর বাড়তি আকর্ষণ ছিলো কোনদিন ট্রেনে না ওঠা আমার ট্রেন ভ্রমণ হবে বলে। অফিসে ক্যালেন্ডারে দাগ কেটে রাখছিলাম। দিন শেষ হবে কবে! অবশেষে কাঙ্খিত দিন। অফিস থেকে সোজা কমলাপুর। হাসিখুশি যে মানুষটার সাথে প্রথম দেখা সে ছিলো টীম লিডার প্রভা। একে একে সবার সাথে দেখা হয়ে বুঝলাম এতদিনে মনের মত কিছু মানুষ পেয়েছি। মোটামুটি পুরো রাতই ট্রেনে কেটেছে গল্প করে। পরদিন সকালে পা রাখলাম সিলেটে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। যাওয়ার আগে শুনেছিলাম বন্যা হচ্ছে। হুট করে মনে হলো হবে তো ঘোরাঘুরি ঠিকমত? আমার আশংকা সম্পূর্ণ উল্টে গেলো সৃষ্টিকর্তার রহমতে।
প্রথম দিনের গন্তব্যস্থল ছিলো পান্থুমাই ঝর্ণা আর বিছানাকান্দি। যাওয়ার সময় সবার একচোট হাসাহাসি আমাকে নিয়ে। পুরো ২১ জনের মেয়ের গ্রুপে আমি নাকি একমাত্র ছেলে। ভাঙা রাস্তায় কোমর ভাঙতে ভাঙতে নৌকা অবদি পৌছুলাম। নৌকায় উঠে হৈ চৈ এর মাঝেই পৌছুলাম পান্থুমাই। কিন্তু তৃষ্ণা বেড়ে গেলো পান্থুমাই ঝর্ণা দেখে। এত সুন্দর একটা ঝর্ণা আর ছুঁতে পারবো না?? সেই আক্ষেপ কিছুটা মিটালাম বিছানাকান্দিতে। সাঁতার না জানা আমার পাথরের উপরে তিরতির করে বয়ে চলা পানিই ছিলো ভরসা। একটু গভির যেখানে সেখানে দম বন্ধ করে পানিতে শুয়ে পরলাম। বয়ে চলা পানির যে অদ্ভুত গান তা অনুভব করলাম প্রথমবারের মত। দম ফুরালে উঠে বসি। আবার দম নিয়ে শুয়ে পরি। কান পাতি, শব্দ শুনি। জলের শব্দ। গেঁথে নেই বুকের ভিতরের কোঠরে। ফেরার সময় পুরোটা নদীপথ নৌকার মাথায় বসে জল ছুঁয়ে এসেছি। পরদিনের গন্তব্য রাতারগুল, জাফলং আর সংগ্রামপুঞ্জি মায়াবতী ঝর্ণা। আবার ভাঙা রাস্তা, আবার হাড় গুড়ো হওয়া। কিন্তু নেমে দুর থেকে রাতারগুল দেখে বেমালুম ভুলে যাই সবকিছু। নৌকা পথ আবার। ভাগ্যক্রমে খুব প্রিয় মানুষগুলো আমরা এক নৌকায়। প্রথমে কিছুক্ষণ হৈচৈ করেছি। এরপর বুঝলাম রাতারগুলের সৌন্দর্য্যই নিস্তব্ধতায়। সবাই একসাথে চুপ করে যাই। ধীরে ধীরে প্রকৃতি মেলে ধরে নিজেকে। পানিতে বৈঠার শব্দ, গাছে পাখি ডাকছে, গাছগুলোতে নৌকার স্রোতে যাওয়া পানির ছলছল শব্দ। কি এক বিষন্নতা মাখানো অানন্দ। কেনো যেনো ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কিন্তু সময় বয়ে গেলো। চললাম জাফলং এর পথে।।
জাফলং পৌছে হতাশ হয়েছি, কান্না পেয়েছে। একি অবস্থা! তবে ছবিতে, টিভিতে যা দেখেছি সব কি ভুল ছিলো। কোথায় এর পাথরভরা পানির সৌন্দর্য্য? শুনলাম মানুষের কড়াল থাবা ন্বিঃষ করে দিচ্ছে।। মন খারাপ নিয়ে এগিয়ে যাই ঝর্ণার খোঁজে। বালু, কাঁচের ছড়াছড়ি মাড়িয়ে ঝর্ণা খুঁজি।। কান পাতি। শব্দ পাই আছড়ে পরা পানির। কিন্তু সুন্দরী কোথায়? অবশেষে সুন্দরীকে পেলাম। অসংখ্য মানুষ। মাথা উঁচু করে সবাইকে শীতল করে চলছে সংগ্রামপুঞ্জি মায়াবতী ঝর্ণা। দৌড়ে গিয়ে পানি ছুঁলাম। কিন্তু ঝর্ণার শরীর না ছুঁলে কি চলে? টীম লিডার ততক্ষণে রওনা করেছে পাথর বেয়ে। প্রথমে একটু সংশয় পারবো তো? ছোট বোন বললো সে যাচ্ছে। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। বেয়ে ওঠা শুরু করি মায়াবতীর কোল বেয়ে, নেমে আসা পানির ধারার স্রোত ছুঁয়ে। পিছনে আমাদের সাথের পাঁচ জন। একজন অন্যজনকে টেনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু উঠছিই। পিচ্ছিল পাথরও থামাতে পারছে না। কি এক মন্ত্রমুগ্ধ অবস্থায় উঠে যাচ্ছি আরও উপরে। একসময় থামলাম। সামনের এগুনোর চেয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা শুরু করলাম। শ্রান্তি ক্লান্তি ধুয়ে চলে যাচ্ছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে পাথরে কান চেপে ধরি। সবাই বলে পাহাড়ের কান্না নাকি ঝর্ণা হয়ে নামে। আমার মনে হলো স্থির পাহাড়ের উচ্ছলতা, সবটুকু চঞ্চলতা ঝড়ে পরছে ঝর্ণা হয়ে। কান পেতে শুনি জলের শব্দ, পাহাড়ের পাথর আর ঝর্ণার এক হওয়ার গান। ফেরার সময় হলো। মনে মনে বললাম আবার আসবো। খাওয়া শেষে গাড়িতে ওঠার আগ মুহূর্তে প্রচন্ড বৃষ্টি। থেমে থাকিনি। বৃষ্টিতে ভিজে ষোলকলা পূর্ণ করলাম। এতগুলো জলের শব্দে বৃষ্টির জলে তো কান পাতাই হয়নি। বৃষ্টি ছুঁয়ে গেলো। কানে কানে বলে গেলো ফিরে এসো। জল তোমার অপেক্ষায় থাকবে।