আমাদের প্রথম ভ্রমণের গল্প।১ম বর্ষের আইটেম, কার্ড,টার্মের চাপে জীবন যখন ওষ্ঠাগত,তখনই একদিনের আড্ডায় প্ল্যান হলো টার্ম শেষে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো। এবার জায়গা নির্বাচনের পালা.।অনেক ভেবেচিন্তে, অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ঠিক করা হলো সিলেট যাওয়া হবে।কিন্তু আমরা ৫ জন মেয়ে,এভাবে ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কারোরই নেই।তাছাড়া বাসা থেকেও অভিভাবক ছাড়া যাওয়া মেনে নেবে না। এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন একজন বড় ভাই..তিনি আমাদের গাইড করবেন বলে আশ্বস্ত করলেন.অনেক কষ্টে বাসা থেকে অনুমতি পেলাম।টার্মের পর সিলেট যাওয়া হবে ঠিক হল..সবার মধ্যে সেই কি উত্তেজনা ! প্রথম টার্ম চলছে তখন।পড়ার মাঝে যখন একঘেয়েমি চলে আসতো,তখনই একসাথে বসে ট্যুর নিয়ে আলোচনায় বসতাম আমি, তামান্না,ঐশী, রাইভী আর সুভ্রা এবং নিমিষেই পড়ার ক্লান্তি দূর হয়ে যেত।দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো.. এর মদ্ধেই ২-১ জনের বাসা থেকে না করে দিলো! দেখা গেলো ৫ জনের মধ্যে ২ জন না গেলে বাকিদের যাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে..শুরু হলো বাসায় ফোন দিয়ে কান্নাকাটি।যাওয়ার আগের দিন, বাসের টিকিট কাটা হয়ে গেলেও আমাদের যাওয়া ছিল অনিশ্চিত।কারণ ২ জন অনুমতি পায় নি তখনো.. প্ল্যান মোটামুটি ক্যান্সেল।কি প্রচণ্ড মন খারাপ ছিল সবার! প্রায় একমাস ধরে করা প্ল্যান মুহূর্তের মাঝেই শেষ হয়ে গেল।রাতে যে যার মত ঘুমিয়ে পরদিন ক্লাসে গেল ২ জন..আর ৩ জন তখনো শোকে পাথর! হঠাৎ তামান্না দৌড়ে এসে বললো সবাই ব্যাগ গুছিয়ে নে, আমরা ট্যুরে যাবো! কেউ আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করে ব্যাগ গোছানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ! জীবনের প্রথম এভাবে ট্যুরে যাওয়া! কতরকমের শঙ্কা কাজ করছে মনে।সবকিছুকে ছাপিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে রাত ৮ টায় বের হলাম আমরা বাস কাউন্টারের উদ্দেশ্যে।অবশেষে রাত ১০.৩০ টায় ইউনিক বাসে করে যাত্রা শুরু হলো।
বাবা-মাকে ছাড়া এই প্রথম দূরে কোথাও যাওয়া! অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা সব বাধা বিপত্তিকে হার মানালো।হেলে দুলে বাস চলছিলো।একটু পর আব্বু আম্মুর ফোন আসছিলো। আমার সাথে সাথে তারাও নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে।তখন মনে হচ্ছিল,কি দরকার ছিল আব্বু আম্মুকে এতো টেনশনে রাখার,ঘুরতে যাওয়ার কি এতোই দরকার ছিল! যাই হোক, রাত বাড়ছিল,জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কুয়াশায় চারিদিক ছেয়ে গেছে।ঢাকায় তখন কি প্রচণ্ড গরম..আর এখানে কুয়াশা ! ভোর ৪ টার দিকে আমরা সিলেটের কদমতলী স্ট্যান্ডে নামলাম বাস থেকে।সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে গেলাম হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজারে।ভাইয়া বললেন আরেকটু ভোর হলে হোটেল বুক করা হবে সেই পর্যন্ত মাজার ঘুরে দেখা যাক। শীতে কাপঁতে কাপঁতে অচেনা এক শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি ভাবতেই উত্তেজনায় কাঁপুনি আরো বেড়ে যাচ্ছিল।তারপর টিল্যান্ড নামের একটি হোটেলের রুম বুক করা হলো,ভাইয়া বললেন ৭ টার মদ্ধে বের হতে হবে,এইটুকু সময় বিশ্রাম নিয়ে নিতে।সারা রাত একটুও ঘুম না হওয়াতে এই দুই ঘণ্টা সময় খুব ভালো করে কাজে লাগিয়ে নিলাম।
উঠে ফ্রেশ হয়ে সিলেটের বিখ্যাত পাঁচ ভাই হোটেল থেকে নাস্তা করে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম জাফলং এর পথে।পথিমধ্যে আগুন পাহাড়,এবং চা বাগানে নেমে ছবি তুলে নিলাম।জীবনের প্রথম চা বাগান দেখলাম! যেতে যেতে হঠাত চোখে পড়লো পাহাড়! সারাজীবন শহর সমতলে বড় হওয়া কেউ যখন প্রথমবারের মতো পাহাড় দেখে সেই অনুভূতি লিখে, বলে কোনোভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়!
যাই হোক জাফলং গিয়ে স্বচ্ছ, শীতল পানির নিচে ডুবে ছিলাম অনেকক্ষণ।তারপর নৌকা দিয়ে নদী পাড় হয়ে,কিছুদূর হেঁটে গেলাম সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা দেখতে। যদিও ঝর্ণায় পানি খুবই কম ছিল,তবুও প্রথমবারের মত ঝর্ণা দেখা বলে কথা! ঝর্ণার বরফশীতল পানিতে গোসল করে ওখান থেকে এবার ফেরার পালা।এবার গন্তব্য লালাখাল।পড়ন্ত বিকেলে লালাখালের অপূর্ব সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করবার মত ন।নৌকা নিয়ে কিছুক্ষণ ভেসে বেড়ালাম রঙিন পানির মাঝে।এবার হোটেলে ফিরবার পালা।ততক্ষণে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।নিস্তব্ধ অন্ধকারের বুক চিরে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে আর সাথে তো আমাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়া রয়েছেই।মনে হচ্ছে যেন স্বপ্নের কোনো জীবনে বিচরণ করছি! সিলেট শহরে পৌঁছে পাঁচ ভাই হোটেলের ১২-১৩ রকমের ভর্তা দিয়ে পেটপুরে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে বিছানায় যেতেই সাথে সাথে ঘুম । সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিলাম পানসীতে। আজকের গন্তব্য সাদা পাথর,ভোলাগঞ্জ।
রাস্তার দুপাশে চা বাগান,দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ,ঘাট পাড় হয়ে পৌঁছালাম দয়ারবাজার।সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করা হলো সাদাপাথর যাওয়ার জন্যে।সচ্ছ পানিতে ভেসে ভেসে কিছুক্ষণ পরেই চলে এলাম গন্তব্যে। একইসাথে পাহাড়,নদী আর পাথরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ধলাই নদের টলটলে পানির সেই কি স্রোত ! যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কোনো দূর অজানায়। তাই আমরাও স্রোতে গা ভাসালাম।আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আমরা ছাড়া তখন সেখানে কোনো পর্যটকই ছিল না।হারিয়ে গিয়েছিলাম স্বর্গীয় পরিবেশে।২-৩ ঘণ্টা পানিতে ঝাপিয়েও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। ভাইয়ার কড়া নির্দেশে উঠতে বাধ্য হলাম।
তারপর বিকেলে মালনীছড়া চা বাগান দেখতে গেলাম। সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো।তারপর কিছুক্ষণ ক্বীন ব্রিজে ঘুরে রাতের শহর দেখলাম।এবার ফেরার পালা। একরাশ স্মৃতি,নতুন অভিজ্ঞতা আরো অনেক কিছুকে সঙ্গী করে ফিরে এলাম জাদুর শহর ঢাকায়। জীবনের অন্যতম সুন্দর একটি অভিজ্ঞতা ছিল এই ভ্রমণটি।স্বপ্ন আর বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল! বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একজন ভ্রমণকন্যার ভ্রমণের শখটি পূরণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।নিরাপত্তার কারণে পরিবার একা ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দিতে নারাজ।এই সমস্যা সমাধানে ভ্রমণকন্যা গ্রুপটি অসামান্য অবদান রেখেছে ।
অসংখ্য ধন্যবাদ ভ্রমণকন্যা!
Name: Fahmida Akter Sathi
Profession: Student