You are currently viewing দশভূজা : নারীর কলমে নারী (দ্বিতীয় ) || পরিচয়

দশভূজা : নারীর কলমে নারী (দ্বিতীয় ) || পরিচয়

মা’র রুমের দরজাটা খুলতেই নাকে ধাক্কা দিলো ভ্যাপসা একটা দুর্গন্ধ। শেষ কবে মাকে গোসল করানো হয়েছে আমার ঠিক জানা নেই। এখানে ওখানে উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার পড়ে আছে। সেখান থেকে পচন, এরপর দুর্গন্ধ। মায়ের পরনের কাপড়টা ঠিক কতোদিন আগে ধোয়া হয়েছিলো তারও ঠিকঠিকানা নেই। বিছানার চাদরে সম্ভবত প্রস্রাব করে দিয়েছিলেন, সেইটা ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা কেউ বোধ করে নি। জানালাটা কবে থেকে বন্ধ কে জানে। টিমটিম করে জ্বলা বালবের আলো চোখে জ্বালা ধরায়।

দরজা খোলার শব্দ পেতেই মা চোখ তুলে তাকালেন। মায়ের চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন। জ্বলজ্বলে, একদৃষ্টে তিনি চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকেন। জ্বলন্ত সেই দৃষ্টি বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। চোখ নামিয়ে নিতে হয়। আমিও চোখ নামিয়ে নিলাম। মা আমাকে দেখে অদ্ভূতভাবে ঘাড় বাঁকালেন। হাতে বাঁধা শেকলে টান পড়লো। শেকলে ঝনঝন শব্দ হলো।

আমার মা পাগল। তাঁকে হাতেপায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।

আমি আর আমার মা আমার নানাবাড়িতে থাকি। ছোটোবেলায় নানা-নানী দুজনের আদরে বড় হয়েছি। এখন তাঁরা বেঁচে নেই। যে কয়দিন নানী বেঁচে ছিলেন, মাকে এইভাবে থাকতে হতো না। তখন তাঁকে প্রতিদিন গোসল করিয়ে কাপড় বদলে দেয়া হতো, সময়মতো খাইয়ে মুখ ধুইয়ে দেয়া হতো, বিছানায় পরিষ্কার চাদর বিছানো থাকতো আর তখন তাঁকে শেকলে বেঁধে রাখতে হতো না। নানী মারা যাওয়ার পরে মা আর আমার দায়িত্ব পড়লো মামা-মামীর ওপর। উনারা আমাদেরকে ফেলে দেননি। আমাকে ভাল পড়াশুনা করিয়েছেন, মাকে ডাক্তার দেখিয়েছেন; শুধু যত্নটাই হয়নি। আমিও মাঝখান থেকে বড় হয়ে গেলাম, পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, মা পড়ে গেলেন অবহেলায়। কাজের মেয়েটা মুখ তুলে ভাত খাইয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু পরিষ্কার করে দিতে ঘেন্না করে।

মা ঠিক কবে থেকে পাগল তা আমি জানতাম না। বোধ হবার পর থেকে মাকে এমনই দেখেছি। মায়ের আদর কখনো পাইনি। বদলে মনের ভেতর জন্ম নিয়েছে মায়ের প্রতি অদ্ভূত এক ভয়। আমি আমার মায়ের কাছে যেতে ভয় পাই। মানুষ পাগলের কাছে যেতে যেমন ভয় পায়, আমি আমার মায়ের কাছে যেতে ঠিক তেমনি ভয় পাই।

আমার বাবাও নেই। বাবা আমার কাছে শুধু একটা নামমাত্র। মৃত মোহাম্মদ আবদুল হায়দার নামটা লিখতে গিয়ে আমার নাকে বাবা বাবা গন্ধ ভেসে আসে না। ওটা শুধু একটা নামই।

গতকাল পর্যন্ত আমার মা ছিলেন শুধু একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী আর আমার বাবা ছিলেন মৃত মোহাম্মদ আবদুল হায়দার। আজকে সকালে নানার রেখে যাওয়া একটা চিঠি আমার হাতে মামা দিলেন। সিলগালা করা চিঠি; আমি ছাড়া কেউ যেন না পড়তে পারে সেজন্য। চিঠিটা আজকে দেয়ার উদ্দেশ্য এই, আজকে আমার বয়স আঠারো পূর্ণ হয়েছে। আজকে থেকে আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। আমার নানা মৃত্যুশয্যায় এই চিঠি লিখে গেছেন আমাকে উদ্দেশ্য করে। চিঠিতে লেখা ছিল-

“নানাভাই,
জানি না এটা পড়ে তোমার মনের অবস্থা কী হবে। তবে যেহেতু তুমি বুদ্ধিমান, তুমি নিজের ভাল বুঝতে শিখেছো, তাই আমার মনে হয় নিজেকে নিয়ে গর্ব করার যথেষ্ট কারণ তুমি খুঁজে পাবে।
যুদ্ধের সময় তোমার মায়ের বয়স ষোল। ষোল বছরের এই মেয়েটিকে অনেক সাবধানে রেখেছিলাম যেন আর্মিদের নজর না পড়ে। শেষরক্ষা হলো না। সেপ্টেম্বরের পনের তারিখ আমাদের বাসা রেইড হলো, তোমার মাকে ওরা উঠিয়ে নিয়ে গেলো। আমি আর তোমার মামা তখন যুদ্ধে, আর তোমার নানী তাকে রক্ষা করতে গিয়ে বুটের লাথি খেয়ে জ্ঞান হারায়।
আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল যুদ্ধ শেষে আমরা আমাদের মেয়েটাকে ফিরে পেয়েছি। সে মানসিক ভারসাম্য হারায়, তবু আমরা তাকে পেয়েছি তো! সাথে তোমাকেও পেলাম পরের বছরই! ভালো থেকো নানাভাই। মায়ের খেয়াল রেখো।”

আমার মা একজন বীরাঙ্গনা। নানা এজন্যই বলেছেন, আমার গর্ব হওয়া উচিত। পাশবিক অত্যাচার সহ্য করে আমার মা আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, আমাকে জন্ম দিয়েছেন। নিজের সত্ত্বাটুকু হারিয়ে আজ বেঁচে আছেন এতোখানি অবহেলা নিয়ে!

আমি মায়ের কাছে এগিয়ে গেলাম ধীর পায়ে, তাঁর শেকল খুলে দেবো বলে। মুক্তির সওগাত বয়ে আনায় যে নারী সব দিলেন, তাঁর হাতেপায়ে কি শেকল মানায়?

তাসনিয়া আহমেদ
এমবিবিএস ৫ম বর্ষ,
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ।

Leave a Reply