You are currently viewing প্রথম যখন পাহাড় দেখা- NUSRAT JAHAN ISHAT

প্রথম যখন পাহাড় দেখা- NUSRAT JAHAN ISHAT

গল্পের শুরুটা বেড়ে ওঠার সময়ে। যে সময়ে আবিষ্কার করেছি এই চার দেয়ালের বাইরেও আরো বিশাল একটা পৃথিবী আছে। ওই পৃথিবীর দিকে তাকাতেই যেন ভাল লাগে। এই ভাললাগা দেখে, তাচ্ছিল্য করে জানিয়ে দেয়া হলো, “নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস”।

নদীবিস্তৃত দক্ষিণাঞ্চল বরিশালে বেড়ে উঠে, নানা প্রতিবন্ধকতার পরেও আমি স্বপ্ন দেখেছি পাহাড়ের। তারপরই একদিন জানতে পারলাম, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর”। ওপারে উত্তরের পাহাড়ের স্বপ্নে বিশ্বাস রেখে পাশ কাটিয়ে গেলাম তর্ককে। নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার দূরত্বে হাতছানি রাখলাম। যেমনটা সুনীল রেখেছিল। সুনীল বলেছিল, নদীর দামে একটা পাহাড় কিনবে। আমিও সুনীলের মতো দেখতে চেয়েছি পাহাড়ে বুকে বয়ে চলা নদীকে। সে নদীর শান্ত অবয়ব আমাকে ডেকেছে অবাধ্য স্বপ্নের মতো।

ভ্রমণের তৃষ্ণা জিইয়ে রেখে অপেক্ষার পালা শেষ হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। ততদিনে কবিতায়, গল্পে, সিনেমায় আর গানে গানে পাহাড়ের কথা জানতে জানতে, পাহাড় জায়গা করে নিয়েছে আমার প্রাণে। সেই প্রাণের টানেই ছুটেছি নদী থেকে পাহাড়ের দিকে- সিলেটে। প্রাত্যহিক একঘেয়ে জীবন থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে পাহাড় দেখতে পাড়ি দিয়েছি চারশ ষাট কিলোমিটার পথ। পথে যেতে যেতে কানে বেজেছে, “ওই দূর পাহাড়ের ধারে, দিগন্তেরই কাছে, নিঃসঙ্গ বসে একটি মেয়ে গাইছে আপন সুরে”। পথ যতই এগিয়েছে ততই যেন ওই নিঃসঙ্গ মেয়ের সুর আরো প্রকট হয়েছে। এভাবেই বিশ্বাসের উপর ভর করে আর পাহাড়কে মনে প্রাণে দেখার স্বপ্ন নিয়ে পৌঁছেছি সিলেটের গোনাইঘাট উপজেলার অনন্য সৌন্দর্যের পাথুরে আর পাহাড়ভূমি বিছানাকান্দিতে।

মেঘালয়ার পাথুরে পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমার প্রথম পাহাড় দর্শন। আর পাথরের ফাঁকে বয়ে চলা ঝর্ণার পানি যেন আমার কাঙ্ক্ষিত এবং অবাধ্য স্বপ্নের প্রতিরূপ। সামাজিক তাচ্ছিল্যকে দূরে ঠেলে, আর ওপারের বিশ্বাসের উপর ভর দিয়ে আমি অবলোকন করেছি পাহাড়কে। দুচোখের পুরোটা দৃষ্টিসীমায় ধরে রেখেছি কেবলই পাহাড়ের ছবি, যা আজও সুখস্মৃতির মতো সুন্দর। যদিও পাহাড়কে খুব কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা তখনো পূরণ হয়নি। দূর থেকে দেখে যতটা পেরেছি, মজবুত করে নিয়েছি পাহাড়ের প্রতি ভালবাসাকে।

আমার এই ভ্রমণ গল্পে, বিছানাকান্দি থেকে গিয়েছি সিলেটের লাউয়াছড়া বনে। গিয়ে দেখা মিলল জানা অজানা কত রকম গাছপালা, লতাপাতা। অবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সেসব। অল্প কিছু দূর হাঁটতেই সামনে পড়ল রেললাইনের সমান্তরাল পথ। বরিশালে রেলপথ নেই, দেখা যে হয় না তা বলাই বাহুল্য। রেললাইনের দেখা পেয়ে তাই বয়স ভুলে আনন্দে মেতে উঠলাম। হেঁটে গেলাম অনেকটা পথ। এরপর চলে গেলাম শ্রীমঙ্গল চা বাগানের খোঁজে। আমার মতন চা পাগল মানুষের জন্য চা বাগান দর্শন ছিলো ঈদের খুশির মতন। চা গাছের ফুল আগে কখনো দেখিনি। হালকা বেগুনী বর্ণের স্নিগ্ধ চা ফুল সহজেই মন কেড়ে নিল। একটা ফুল ছিড়ে কানে গুজে দিয়ে চষে বেড়ালাম চা বাগান।

বিকেলে ঘুরে দেখেছি সিলেট শহরও। সিলেট শহরটা যেন সবসময় তরুণ ও সতেজ। একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে করে। রাতের সিলেট যেন আলো আধারির রহস্যে ঘিরে ধরছিলো বারবার। পথ এগোতে ভালোলাগার পাশাপাশি ফিরে যাবার ভীতি চেপে বসেছিল খুব করে। প্রথমবারের মতন যাওয়া সিলেটে তাও মনে হচ্ছিলো এই শহর মায়ায় ঘেরা, এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে আমার আত্মাকে। এই বারবার যাওয়ার ইচ্ছেটাকে পুঁজি করে ফিরতে হয়েছে আবারো আপন ঠিকানায়। ফেরার পথে কানে বেজেছে, “আরো একবার চলো ফিরে যাই, পাহাড়ের ওই বুকেতে দাঁড়াই”। যেন পাহাড়ই ডাকছে আমাকে। হ্যাঁ, এই ছোট ভ্রমণ গল্পের শেষটায় পাহাড়কে আরো কাছ থেকে দেখার, পাহাড়কে আলিঙ্গন করার আরো বড় স্বপ্ন চোখে নিয়ে ফিরেছি। যেন শেষ মানেই আবার একটা স্বপ্নের শুরু, আরেকটা গল্পের শুরু। আবারো কোনও এক দিন এই স্বপ্ন আর পাহাড়ের টানে ফিরে যাব অন্য কোন পাহাড়ে, লিখব অন্য কোন গল্প।

Leave a Reply