You are currently viewing ফুলের উপত্যকা- জ্যুকো

ফুলের উপত্যকা- জ্যুকো

প্রমােদভ্রমণের অবিন্যস্ত সুখ স্মৃতিগুলােকে কালাে কালির খাঁচায় একত্রে সযত্নে বন্দি করে রাখবার জন্যই লেখালেখির প্রয়ােজনীয়তা বিশেষ পীড়া দিচ্ছে, তাছাড়া প্রবীণ জীবনের পড়ন্ত বিকেলগুলােতে এই অালুথালু বন্দি অক্ষরগুলােই তাে চিত্ত প্রশান্তির প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে তাই লিখতে বসেছি।

নাগাল্যান্ডের ভিসামায় ৩.৩০টায় ট্যাক্সি থেকে নেমে ১,৩০০ আর ১,৭০০ রুপির বাকবিতন্ডা চললাে আধাঘণ্টা, অগত্তা ট্যাক্সি ড্রাইভারের গাে মিটিয়ে বিদেয় দেবার পর চঞ্চলের মুখ কালাে, ট্যাকের কড়ি আশাতীত খরচ হলে যা হয় আরকি। অতঃপর চা চক্রের সাথে চললাে নাম রেজিস্ট্রেশন পর্ব, জনপ্রতি ২০০ রুপি, আমি চঞ্চলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর মুখটিপে হাসছি।

এখান থেকে জ্যুকো ভ্যালীর ট্রেকিং শুরুর পথের দূরত্ব ৮ কিঃমিঃ আর জ্যুকো ভ্যালী ০ কিঃমিঃ। সাধারণত দুপুর ২.৩০টার পরে কেউ জ্যুকো ভ্যালী ট্রেকিং এ যায়না স্থানীয়রাও নিষেধ করেছিল কিন্তু আমরা তাে বাঙালি ভয়কে থােড়াই কেয়ার করি। টাটা সুমােতে করে যতক্ষণে ট্রেকিং এর যায়গায় পৌঁছলাম ততক্ষণে ৪.৩০টা বেজে গেছে। আমার সামনে দানবসদৃশ এক গাঢ় সবুজ পাহাড় দাঁড়িয়ে নিজের সুবিশাল অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আনুমানিক এক ঘণ্টায় এই পাহাড় চড়াই পেরিয়ে চূড়ায় উঠবার পর বেশকিছু পাহাড়ের গা-বেচেলা প্রায় সমতল ৩.৩০ ঘণ্টার সর্পিলাকার রাস্তা।

অতঃপর পাহাড় চড়াই শুরু হলাে। পাহাড়ের গায়ে অমসৃণ পাথড়ের সিঁড়ির মতাে রাস্তা। মজার ব্যাপার হলাে দশ মিনিট পাহাড়ে উঠবার পর বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হলাে। কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নেবার জন্য থামছি আর চারপাশে তাকিয়ে দেখছি বুনাে ঝােপঝাড়, অতিকায় দৈত্যাকৃতির গাছ, গাছের গায়ে সবুজ শ্যাওলার স্কুল প্রলেপ যেন প্রাগ ঐতিহাসিক যুগ থেকে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে আছে একে অপরের সাথে। পাহাড়ে ট্র্যাকারদের জন্য অনেক জায়গায় উৎসাহব্যঞ্জক শব্দশৈলী দেখতে পেলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার এত ঘন পাহাড়ি বনে পাখির কোলাহল নেই বললেই চলে। বিপত্তি ঘটলাে এক ঘণ্টা পর। পাহাড়ের দুই তৃতীয়াংশ পেরুনাের পর দিনের আলাে শেষ হয়ে গেল ঝুপ করে। ঘন গাছপালা আর ঝােপঝাড়ের কারণে এতই গাড় অন্ধকার হলাে যে সামনের সিঁড়ি ঠিকমতাে ঠাহর করা যাচ্ছিলোনা। সাথে সাধের টর্চখানার আয়ুষ্কাল তখনি শেষ হবার ছিল, কোনো রকম কবিরাজি করেও আর টর্চ জ্বালানাে গেলনা, ভাগ্যিস কোন মহান ব্যক্তি মােবাইল নামক বস্তুটার সঙ্গে একটা টর্চ লাগিয়ে দিয়েছিলেন বলেই সেযাত্রায় রক্ষা। আরও প্রায় আধা ঘণ্টা লাগলাে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে। পাহাড় চূড়া হতে নিচের দিকের দৃশ্য দেখতে সবসময় মনােমুগ্ধকর, সন্ধ্যের আবছা আলােয় ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে যৌবনা সনাতন রমনীর শুভ্র শাঁখা সদৃশ বৃত্তাকার মেঘের ভেতরে দূরের শহরের লাল বাতিগুলাে জ্বলজ্বল করছিল, যেন শুন্যে ভাসমান সাদা মেঘের ভেতর এক ফালি নক্ষত্রের শহর সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য।

চারপাশে খােলা আকাশ – শীতল হাওয়া বইছে সাথে মেঘের ঝিরঝিরি বৃষ্টি। বর্ষাতি গায়েচেপে পাহাড়ের গা-বেয়ে সর্পিলাকার প্রায় সমতল সরু পথ ধরে এগুচ্ছি । আবছা আলােয় আশপাশের পাহাড়ের অবয়ব দেখছি , সবগুলাে একে অন্যের গায়ে হেলান দিয়ে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আছে , দুপাশে পাহাড় আর মাঝখানে বয়ে চলা সংকীর্ণ নদী যদিও তা পুরােপুরি দৃষ্টিগােচর হয়না কিন্তু তার অবয়ব বুঝা যায় ।

প্রায় অসাড় শরীরে রাত ৮ . ৩০টায় আমরা পৌঁছুলাম জ্যুকো ভ্যালীর ক্যাম্পে। ক্যাম্প বলতে ২টি ডরমেটরি আর রান্নাঘর, একটু দূরে ভিআইপিদের জন্য আলাদা থাকবার ব্যবস্থাও আছে। ক্যাম্পের সামনে শুকনাে প্যাকেটজাত খাবার ও চায়ের ছােট্ট একটা দোকান। বিশাল ডরমেটরিতে তখন চলছিল আগন্তুক পর্যটকদের হই-হুল্লোড়, নাচ,গান,গল্প। রতন ভাই আগে পৌঁছেই আমাদের খাবার আর বিছানার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার তত্বাবধানে থাকা নাগা তিনটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হলাে বেশ স্পষ্ট ভাঙা ভাঙা শব্দে ইংরেজি বলে। “ ক্যাম্পে রাত ৮টার মধ্যে খাবার পর্ব শেষ হয়ে যায়, আমাদের ভাগ্য ভালো কিছু খাবার অবশিষ্ট ছিল তা খেয়েই এই নিশী লগ্ন পারি দিতে হবে, ভিন্নভাবে রান্না হবেনা ” – এই কথা জানিয়ে দিল এক ছেলে। অগত্যা ভাত, সব্জি আর ডাল দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। বিছানায় যাবার পর রাত যতাে গভীর হলাে শীতের প্রকোপ ততােই বাড়ল , কম্বলের উষ্ণতা আর কাজ করছেনা, ঘুমও লাপাত্তা, হয়তাে হাই এলটিটিউড (৭,৯৯৮ফুট উপরে), আগন্তুকদের হইহুল্লোর, উচ্চস্বরের গান আর কনকনে শীতের জন্য।

ভ্যালীতে ভাের ৭টায় একবার বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে এসেছিলাম সবই মেঘে ঢাকা আর প্রবল শীতল বাতাসে হাড়ে ডুগডুগি বাজিয়ে দেয়, বিছানার উষ্ণতাকে গায়ে মেখে সকালের নাস্তা নুডলস আর খেজুর পেটুকশাহর মাজারে চালান দিয়ে আবার ক্যাম্পের সামনে পাতানাে কাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম ততক্ষণে জ্যুকো আমার অন্তর ভরিয়ে দিয়েছে। ক্যাম্প থেকে জ্যুকো ভ্যালীর পুরাে ছবিটা একসাথে দেখা যায় যা অবর্ণনীয়। যেদিকে তাকাই প্রশান্তির সবুজে মােড়ানাে চাঁদর। চারপাশের পাহাড় দিয়ে ঘেরা মাঝখানের অবিন্যস্ত অসংখ্য ছােট ছােট টিলা মাথা উঁচু করে উঁকি মারছে। নিস্তব্ধ পাহাড়ের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখছি। মিনিটের মধ্যে মেঘ এসে ভ্যালীর মাঝের টিলাগুলােকে সাদা শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে ঘােমটা খুলে গােপন সৌন্দর্য দেখাচ্ছে আমাকে। আমার বসবার বেঞ্চের আশেপাশে হরেক রঙের ক্ষুদ্রাকায় সাদা, বেগুনি , হলুদ ফুল যেন ফুলের বাগানে বসে আছি। বেগুনি ফুলটাই সম্ভবত জ্যুকো লিলি যার জন্য জ্যুকো ভ্যালী বিখ্যাত। ঘণ্টা দেড়েক হাঁটলে মূল ভ্যালীতে যাওয়া যায়। সরু রাস্তা, দুপাশে ফুট তিনেক লম্বা ঘন সরু বাঁশের ঝােপঝাড়, তারমাঝে রঙিন ফুলের গাছ ভ্যালীর মাঝ বরাবর বয়ে গেছে স্ফটিকাকার শীতল অগভীর জলের অপ্রশস্থ নদী। তবে ভ্যালীর পাহাড়গুলােতে তেমন কোন বড় গাছ নেই, কিছু গাছ ডালপালাহীন মৃত বিধায় অনেক দূর অব্দি পাহাড়গুলাে একসাথে দেখা যায় – স্বর্গীয় সে দৃশ্য।

ফিরবার সময় বিষণ্নতায় মনটা ছেয়ে গেল। শ্যামল পাহাড়ে অনেক যায়গায় চিত্তহারী শব্দশৈলীর সাথে সাক্ষাত হয়েছিল তার মধ্যে একটা দিয়ে শেষ করতে চাই ,

If you truly love nature ,you will find beauty everywhere

সুলতানা জিয়াসমিন সুমি ,চাকুরীজীবী

Leave a Reply