ছোটবেলায় বেড়াতে যাওয়া বলতে বুঝতাম দাদু নানু বা মামা খালার বাসায় বেড়াতে যাওয়া। খুব বেশি হলে আশেপাশে রিকশা করে একটু ঘুরে আসা সাথে চটপটি ফুচকা খাওয়া। এর বাইরেও যে বিশাল এক পৃথিবী রয়েছে তা বুঝেছি প্রথম সমুদ্র দেখার পর। টানা পাঁচ মিনিট আমি কোনো কথাই বলতে পারিনি। ঘন নীল পানি চারদিকে। যতদূর চোখ যায় তা যেন আকাশের মতোই অসীম। অথচ তাকে ধরা ছোঁয়া যায়! এর পর থেকে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছেটা আমার ভেতর নেশার মতো ঢুকে গেল। কিছুদিন পরপর ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু খুব বেশি সুযোগ হয় না। বাসা থেকে একা একা কোথাও যেতে দেয়া তো দূরে থাক এমনকি বন্ধুরা সবাই মিলে কোথাও যেতে দেয়াতেও প্রবল আপত্তি। সব যায়গায় নিরাপত্তার অযুহাত আর সেই বস্তা পঁচা উপদেশ, বিয়ের পরে জামাই নিয়ে ঘুরবে।
খুবই মেজাজ খারাপ লাগতো। কাউকে বোঝাতে পারতাম না ঘুরে বেড়ানোটা মানুষের মনের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য কতটা জরুরি।
মফস্বলে বড় হয়েছি। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকায় এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। তখন আমি অনেকটা স্বাধীন৷ খুব বেশি কোথাও যাওয়ার সুযোগ না হলেও আশেপাশেই নিজের মতো ঘুরে বেড়াই। তখন ভার্সিটির সবচেয়ে পাগলাটে আর খ্যাপা ছেলেটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হলো। সে কথায় কথায় বলতো তোর যে এতো ঘোরার শখ তোকে অনেক জায়গায় নিয়ে যাবো আমি দেখিস। তার এই কথার কি মানে তখন বুঝতাম না। বুঝেছি ছয় বছর পর যখন তারই সাথে বিয়ের পর প্রথম দেশের বাইরে কোথাও পারি জমালাম। স্বপ্নপূরী ইন্দোনেশিয়ার বালিতে।
বালি আমার কাছে রূপকথার রাজ্যের মতো লেগেছে। রূপকথার বন্দি রাজকন্যা হঠাৎ মুক্তি পেলে যেমন লাগে ঠিক তেমনি।
বালিতে শত শত প্রাচীন মন্দির। কতো হাজার বছরের কতো গল্প জমা করে নিয়ে আছে তারা! বালিকে ঘিরে রেখেছে নীল হ্রদ আর সমুদ্র। আছে কতো যে পাহাড়। আছে আগ্নেয়গিরি আছে রাইস ট্যারেস। কি নেই সেখানে! সবচেয়ে আন্তরিক ওখানকার মানুষগুলো।
আমরা ছিলাম বালির কুটা শহরে। কুটা বিচের একদম সাথেই ছিল আমাদের হোটেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেতাম শান্ত এক সমুদ্র৷ ছিমছাম একটা শহর। মানুষ রং-বেরং এর ড্রেস পরে ঘুরছে। মিউজিক হচ্ছে আড্ডা হচ্ছে। রাস্তা ধরে এগুলে একটু পরপরই চোখে পরে প্রাচীন সব মন্দির। প্রতিটি মন্দিরে টকটকে বাগান বিলাস ফুলে ভর্তি গাছ। প্রথম দিন গেলাম তানাহ লট টেম্পল। সমুদ্রের মাঝামাঝি জায়গায় উঁচু পাহাড়ের উপর মন্দির। একধারে পাহাড় অন্যপাশটা সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। সেখানে সন্ধ্যা মিলানোর দৃশ্যটা না দেখলে মনে হতো জীবন বৃথা।
পরদিন মোটর বাইকে করে গেলাম জাতিলুয়েহ রাইস ট্যারেস। কুটা শহর ছেড়ে যতই আগাতে লাগলাম ততোই শীত লাগতে লাগলো। পাহাড়ি রাস্তার একধারে পাহাড় অন্যদিকে রাইস ফিল্ড। যতদূর চোখ যায় খালি সবুজ আর সবুজ। বাইরের পৃথিবীর কোনো কোলাহল নেই। পাহাড়ের ধারে ঝরনার পানি বয়ে চলার শব্দ আর কেবলই বাতাসের শব্দ। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ জমে আছে। হঠাৎ মনে হতে লাগলো এ যেন অবাস্তব কল্পনার কোনো রাজ্য। বলে কিছুই বোঝানো যাবেনা।
বালি অদ্ভুত জায়গা। কুটা নাতিশীতোষ্ণ এলাকা অথচ ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা পেরিয়ে জাতিল্যুয়েহ তে রাতে শীত শীত লাগে। পথে কত কি দেখার আছে! প্রজাপতি পার্ক, মাংকি ভিলেজ, প্রাকৃতিকভাবে কফি বানানোর কারখানা। সবচেয়ে বিখ্যাত বালির সুইং প্যাকেজগুলো। সময়ের অভাবে আরো অনেক কিছুই দেখা হয়নি।
শেষ দিনে গেলাম নুসা পেনিদা। সে ভয়ানক সুন্দর জায়গা। উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে দেখলাম উত্তাল এক সমুদ্র আছড়ে পরছে পাহাড়ে৷ প্রবল বেগে পানিগুলো যেন মুহুর্তেই মেঘ হয়ে জমে যাচ্ছে। আজলা ভর্তি করে পানি নিলে বুঝি মনে হবে পানির রং নীল।
ভরা জোছনার নীলচে আলোয় মাটি থেকে অনেক উপরে ঠিক আকাশের কাছাকাছি বসে আমরা যখন নুসাপেনিদার ব্রোকেন বিচে সমুদ্রের আছড়ে পরা দেখছিলাম,, তখন বুকের মধ্যে একটা হাহাকার জন্মায়। এতো অদ্ভুত সৌন্দর্য ধারণ করার ক্ষমতা কি তুচ্ছ মানুষের আছে? যে পৃথিবী এতো সুন্দর তাকে ছেড়ে মানুষ স্বর্গে কেন যেতে চায় কে জানে!
আমার ঘুরে বেড়ানোর অনেক শখ ছিল কিন্তু সুযোগের অভাবে অনেক সময়ই অনেক জায়গায় যেতে পারিনি। তখন ট্রাভেলেটস অফ বাংলাদেশ এর মতো এমন একটি নির্ভরযোগ্য গ্রুপ থাকলে হয়তো আরো অনেক স্বপ্নপূরণ হতে পারতো৷
যে পৃথিবী কল্পনার চেয়েও ঢের সুন্দর, তাকে ঘুরে দেখার এতো চমৎকার ব্যবস্থা ট্রাভেলের এই গ্রুপটি করে দেয়ার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।
ফেরদৌসী ইসলাম পূর্ণতা
ইভিনিং এমবিএ, ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়