You are currently viewing বৃষ্টির গল্পে কেওক্রাডং

বৃষ্টির গল্পে কেওক্রাডং

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়লো দলের বাকি সবাই মাটিতে বসে জিরোচ্ছে। রায়াকে কোলে করে ওর বাবা চলছিল তার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলতে চলতে একটু পিছিয়ে পড়ছিলাম বৈকি। এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। দলের সাথে আরো এগারোজন আছে আমি আর পুঁচকে রায়া সহ মোট ১৩ জন। ও বলা হয়নি এই কেওক্রাডং ট্রিপের সবচেয়ে পিচ্চি সদস্যা হলো ২বছর ২ মাস বয়সী রায়া! গত পরশু রাত থেকেই মুলত আমাদের ভ্রমণ শুরু। ঢাকা থেকে বাসে করে বান্দরবান শহরে আসা, সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে সোজা বগালেকের কাছাকাছি কমলাবাজার। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসা হালকা অন্ধকারে আমরা যখন কমলা বাজার থেকে ট্রেকিং করে প্রায় খাড়া একটা পাহাড় বেয়ে বগালেক ঢুকছি তখনো ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি পাহাড়ি পথটাতে একটু এদিক সেদিক হলেই সোজা নিচে পড়ে যেতে হবে।

বগালেক পৌঁছেই সবাই ধপাস করে বসে পড়লো! ঘেমেটেমে একাকার। পাহাড়ি ঘরে কোনরকমে ব্যাগগুলো রেখে নেমে পড়লাম বগালেকে। যদিও বগালেকে নামা বারণ তবুও আমরা খুব সতর্ক হয়েই লেকের একদম কিনারে গা ডুবিয়েই ক্লান্তি দূর করছি। রেদোয়ান ভাই আমাদের টিম লিডার তার কথামতো আমরা সবাই একে একে গোসল সেরে উঠে পড়লাম। আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ। পাহাড়ে এসে প্রাকৃতিক লেকের ধারে এভাবে চাঁদকে পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার! অবিরাম জোছনায় আমরা যখন ভিজছি তখন‌ই গান ধরলো সাব্বির ভাই আর অধি। গলা মেলাতে ব্যস্ত তখন আরো কয়েকজন। চোখ তুলে আকাশ আর চাঁদ দেখছি সাথে গানের সুর গুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার অন্তর। জোছনায় কতক্ষণ যে ভিজলাম তা সঠিক জানা নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার খাওয়ায় ডাক এলো। সারাদিনের ভ্রমণ ক্লান্তি আর লেকের শীতল পানিতে গা জুরিয়ে পেট পুরে খাওয়ার পর দুচোখে যেন রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। কাল ভোরেই কেওক্রাডং সামিটের উদ্দেশ্য র‌ওনা হতে হবে তাই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টের‌ই পেলাম না।

ঘুম ঘুম চোখ রগরাতে রগরাতে যখন ঘর থেকে বের হলাম তখন সুর্যের আলো ফুঁটছে কেবল। তখনো আমাদের দলের কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। রায়াও ঘুমোচ্ছে। ভোরের এই সৌন্দর্য দেখতে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। এখানে এসে যে জিনিসটা সবচাইতে বেশি ভাল লাগে তা হলো এই পাহাড়ি ঘর থেকেই বের হয়েই চোখে পড়বে দূরের পাহাড়। পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছোট্ট এই গ্রামটার মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য খেলা করে, আমি অনেকক্ষন মুগ্ধ চোখে এই সৌন্দর্য দেখি আর বুক ভরে তাজা বাতাস নেই। আর বগালেকের পাড়ে বসে স্বচ্ছ জলে ছোট ছোট মাছেদের খেলা করার দৃশ্য যেন একদম মনে গেঁথে যায়। দেখতে দেখতে বেলা বাড়ছে। অন্য সবাইও একে একে উঠে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। সকালের নাশতায় ছিলো খিচুড়ি আর ডিম ভাজা। অমৃত মনে হতে লাগলো এ খাবারটা। খাওয়া পর্ব শেষ হতেই সবাই প্রস্তুত কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে র‌ওনা হবার জন্য। রেদোয়ান ভাইয়ের একটা ব্রিফিং সাথে গাইডের কিছু নির্দেশনা নিয়ে আমাদের পথ চলা শুরু।

রায়া তার বাবার কোলে চড়েই যাচ্ছে। অন্যরা সবাই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। ও আরেকটা কথা বলা হয়নি, আমরা কিন্তু কেওক্রাডং এ আজকের রাতটা থাকবো তাই সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে নিয়েছি আর বাকি সবকিছু বগালেকেই সেই পাহাড়ি ঘরে রেখে যাচ্ছি। প্রয়োজনের বেশি কিছু বোঝা বানিয়ে পিঠে নিয়ে ট্রেকিং করা মানে নিজেকেই কষ্ট দেয়া। দলের সদস্য আরাফাত, সানাউল্লাহ ভাই আর ম্যাড ইন ভাইয়ের আমাদের সাথে প্রথম ভ্রমণ আর অন্য তিন সদস্য হিমেল, অধি এবং রানার সাথে পরিচয় বান্দরবান শহরে। ওরাও আমাদের সাথে এক‌ই পথের পথিক তাই খরচ কমিয়ে আনতে একটা দলের সাথে যুক্ত হয়ে যাওয়া আরকি। বাকি অন্য তিনজনের একজন হলো মোয়াজ্জেম, সাব্বির ভাই আর অন্যজন জিনি, দলনেতা রেদোয়ান ভাই। আমি আর আমার স্বামী রাজ আর আমার পুঁচকে মেয়ে রায়া। এই আমরা ১৩ জন সাথে গাইড শাহিন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তাপ যেমন বাড়ছে তেমনি ক্লান্তিও ফুঁটে উঠছে সবার চোখেমুখে।

প্রায় আধঘণ্টা ট্রেকিং শেষে একটু বিশ্রাম নেয়ার প্রয়াস। তখন আবার আড্ডা বা হাসি ঠাট্টায় গা থেকে ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার কৌশল রপ্ত করছি। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ বেয়ে চলছি আর মাঝে মাঝে সাব্বির ভাইয়ের গানের সাথে গলা মেলাচ্ছি। বুনো ফুল আর সবুজ রঙের পাতায় এগিয়ে চলা পথটা যেন অনেক বেশি সুন্দর হয়ে আছে যেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে। অনেকটা পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আমরা। এখন মে মাস,বৈশাখ শেষ হয়ে জৌষ্ঠ মাস চলছে। গরমের তীব্রতা আর নাইবা বলি।

প্রায় তিন, সাড়ে তিন ঘন্টা ট্রেকিং করে যখন বিশ্রাম নিচ্ছি তখন খেয়াল করলাম আকাশের এককোনে কালো মেঘেরা ভীড় জমাচ্ছে। রোদ নেই একদম। বৃষ্টি নামতে পারে যেকোনো সময়। মনে মনে খুশি হলাম যে যাক রোদ তো গেলো, গরমও কমলো কিন্তু অন্য দিকে বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি রাস্তা আবার পিচ্ছিল আর বিপদজনক। আর কিছু দূর এগুলেই দার্জিলিং পাড়া। কেওক্রাডং এর কাছের একটি গ্রাম। দ্রুত পা চালালাম সবাই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে পড়লো। বৃষ্টিতে ভিজে খুব বেশি বাতাসের মধ্যেই আমরা এগিয়ে চলছি। একটা গামছা শরীরে পেঁচিয়ে রায়াকে বৃষ্টি থেকে আড়াল করার চেষ্টা আর মাথার উপর একটা ছোট ছাতা ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে ওর বাবা। বৃষ্টি কমছে আবার বাড়ছে শেষমেষ সবাই ভিজেই দার্জিলিং পাড়ায় পৌঁছালাম। কিছুটা বিশ্রাম আর হাল্কা খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি বৃষ্টি থেমে যাওয়ার প্রার্থনায় রত সবাই। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মনে হলো বৃষ্টি থেমে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হবার ইঙ্গিত পেলাম আমরা।

এবার আরো খাঁড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে হবে আমাদের তাই দেরি না করে র‌ওনা হয়ে গেলাম। কিন্তু বিধিবাম একি! হঠাৎ আগের চেয়ে আরো কয়েকগুণ জোরে বৃষ্টি আরম্ভ হলো সাথে প্রচন্ড বাতাস। পিচ্ছিল হয়ে উঠা পথ বেয়ে এগিয়ে যাওয়া যেন আরো কষ্টকর হয়ে উঠলো। সবার সাথে থাকা ব্যাগ‌গুলোও রেইনকাভার থাকার পরেও প্রায় ভিজে নেয়ে একাকার। দার্জিলিং পাড়া থেকে অনেকটা পথ আমরা খাঁড়া উঠছি এই বৃষ্টির মাঝেই। আর কিছুটা পথ হাঁটলেই সামনে কেওক্রাডং দেখতে পাবো এরকম সময়ে বৃষ্টি থেমে গেলো। রাস্তা গড়িয়ে পানি পড়ছে আর রাস্তার দু ধারের প্রকৃতি আরো বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে। অবশেষে স্বপ্নের কেওক্রাডং এর একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। সিঁড়ি ভেঙে যখন আমরা কেওক্রাডং এর চূড়ায় পৌঁছে গেছি তখন‌ও দিনের আলো অনেকটাই অবশিষ্ট।

একদম উপর থেকে আশেপাশের পরিবেশটা এতো বেশি সুন্দর লাগছিলো যে মুগ্ধতায় আমাদের সব ক্লান্তি একদম উধাও! ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুরিয়ে আসছে। যে যার মতোন ছবি তুলছে আর কয়েকজন বসে পড়ে প্রকৃতির রূপ দেখছে অপলক দৃষ্টিতে। যতদূর চোখ যায় শুধু উঁচুনিচু পাহাড়ের সাথে মেঘের সখ্যতা আর সবুজের নির্মলতার মাঝে আকাশের নীলের মিলিয়ে যাওয়া চেয়ে দেখছি। প্রকৃতির এই বিশালতায় অতি ক্ষুদ্র আমি,আমরা। ভাললাগার এই সৌন্দর্যের মাঝে কেটে যাবে আজকের রাতটা ভেবেই শিহরিত হচ্ছি, প্রস্তুতি নিচ্ছি স্বচ্ছ সাদা ধবধবে জোছনায় ভিজে যাওয়ার জন্য, কারণ আজ যে পূ্র্নিমা…

ফারজানা ইয়াসমিন ঊষা

Tour Organizer at Nature Hawker

Leave a Reply