আমার কলিক ভাবনাগুলো এলোমেলো ভাবে ছুটে চায়, আমার স্বপ্নগুলোকে। পৃথিবীর সহজ সরলতম কোন এক উপত্যকার আর দশটা মানুষের মতন আমার জন্ম। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নটা সে ছোটবেলা থেকে। অবশেষে সুযোগ হলো এবারের রমজান ছুটিতে ডিম পাহাড়ে যাওয়ার। মনে হলো এবার বুঝি আমার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নটা পূরন হবে। ডিমপাহাড়ের গল্পটা আমার এক ভাই এর জাছ থেকে শুনেছি। উঁচু পাহাড়ের গায়ে অনায়াসে মেঘ ছোঁয়া। ঢাকা টু বান্দরবান টিকেট কেটে রওনা দিলাম রাতে। সকালে বান্দরবান পৌছেঁ হালকা নাস্তা করে দিদিদের সাথে বান্দরবান টু থানচি বাসে উঠে গেলাম। রাস্তায় উঁচু নিঁচু পাহাড়, এত সুন্দর দৃশ্যপথ, মনে হচ্ছিল আমি এই প্রথমবার দেখছি। পথে পথে অনেক আদিবাসিদের গ্রাম দেখলাম। দৃশ্যগুলোর মাঝে হারাতে হারাতে পৌছে গেলাম পিক 69 এ । কখনো ভাবিনি এ রকম একটা জায়গায় আমার সৌভাগ্য আমার হবে। সামনে জীবন নগর পাহাড় পরল, যেখানে বাতাসের চাপ এতই ছিল মনে হচ্ছিল কখনো কান খুলছে আবার কখনো বন্ধ হচ্ছে।
এক অদ্ভুদ অনুভূতি কাজ করছিল। প্রায় ১০ মিনিট লেগে গেল পাহাড় থেকে নামতে। তারপর পৌছে গেলাম বুলিবাজার। সেখান থেকে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে পৌছে গেলাম থানচিতে। থানচিতে পৌছে মনে হলো আসলে এটি সর্ব পূর্বদিকে অবস্থিত। আসার সময় যে ঠান্ডা হাওয়া অনুভব করেছিলাম এখানে এসে মনে হলো অনেক গরম। সেখান থেকে মটর সাইকেলে করে ডিমপাহাড়ের দিকে রওনা হলাম। থানচি টু লামা রাস্তা। একটার পর একটা উঁচু নিঁচু পাহাড়, মনে হচ্ছিল আমি উড়ছি। অবশেষে ডিমপাহাড়ে পৌছে গেলাম। পাহাড়ে উঠার সময় সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প পড়ল, যেখানে কিছু তথ্য দিতে হল। তারপর পাহাড়ে উঠতে লাগলাম, যতই উপরে উঠছি মনে হচ্ছিল আবাহওয়া বদলে যাচ্ছে। কোনো এক শীত প্রধান দেশে আমি দাড়িয়ে আছি। মনোসুগ্ধকর দৃশ্যগুলো দেখে মনে হল আমার মনে হল আমি বোধহয় দার্জিলিং এ পৌছে গেছি। মেঘগুলো ধরা যাচ্ছিল। উপড়ে পৌছে দেখলাম সূর্যের কোনো দেখা নাই।

একটা টং ঘর(চা দোকান) দেখলাম। সেখানে ভিতরে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। চা হাতে পৌছাতে পৌছাতে প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল। দোকানদার এর কাছে জায়গাটার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, এখানেই সারাবছর শীত থাকে। সূর্য্যের আলো দেখা মেলে না। কথিত আছে, এখানে নাকি ডিমঝুড়ির মতো দেখতে গুপ্তধন আছে, আর এখানে বাতাসের চাপ এতটাই একটা ডিম সিদ্ধ করতে সারাদিন লেগে যায়।
পাহাড়ের একটু নিচে এক ম্রো আদিবাসীদের গ্রাম। খেয়াল করলাম ছোট ছোট ছেলে- মেয়েদের জুম চাষের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পড়াশুনার কথা বলতেই বলল, স্কুল অনেক দূরে আর পড়াশুনা করিয়ে সন্তানদের বড় কিছু বানানো আকাশ কসুম চিন্তা করা ছাড়া কিছুই নয়। তাঁরা দিনে আনে দিনে খায় সন্তানদের পিছনে এতো ব্যাকআপ দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই জুম চাষের মাধ্যমে বেচেঁ থাকার লড়াই শিখিয়ে দেওয়া হয়। এটাই তাদের বাস্তবতা এবং এটাকে তারা মেনে নিয়েছে। আমাদের মতন লাল মাটি না তাদের পাহাড় বলতে পাথরের পাহাড়। এসব পাথরের পাহাড় খুড়েঁ খুড়েঁ জুমচাষ করে জীবন যুদ্ধে জয় হওয়ার প্রয়াস করেই চলেছে প্রতিনিয়ত। তাদেঁর দেখে মনে হল আমরা কতই না সুখে আছি। আগে ভাবতাম আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত কিন্তু তাদেঁর দেখে বুঝতে পারলাম বাস্তবতা কি? কত কিছু থেকে তাঁরা বঞ্চিত। যেখানে তাদের পানি আনতে সারাদিন লেগে যায় সেখানে আমি হলে হয়ত পারতাম না। তারা হয়ত আজ রাস্তাঘাত বাজার দেখেছে কিন্তু তাদের পূর্ব পুরুষরাতো তাও দেখে যেতে পারেননি। শক্ত হাতে পাথর খুড়ে জুম চাষ করার সংগ্রাম করে বাঁচার লড়াই লড়ে গেছেন আজীবন, হয়তো এটাই আদিবাসীর মূল তত্ব। তাদেঁর জীবন প্রণালী দেখে উপলদ্ধি করতে পারলাম জীবন কতটা কঠিন। একজন আদিবাসী সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষার গন্ডি পেড়িয়ে বেড়িয়ে আসাকে আমরা যত সহজ মনে করি। বাস্তবে তা কিন্তু নয়। একজন আদিবাসী যখন উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে আসার পেছনে অনেক কষ্ট, ত্যাগ আছে যা আমি তাদের দেখে উপলদ্ধি করেছি। আমার অনেক বন্ধুরা বলে তোমাদের জন্য কেন আলাদা কোটা থাকবে? আমিও একসময় কোটার বিরোধী ছিলাম, কিন্তু তাদের দেখে মনে হল এসব পরিবেশ থেকে উঠে যারা আসে, এত কষ্ট করে, তাদের জন্য এইটুকু সুযোগ তো থাকা উচিত।
অবশেষে বাড়ি ফেরার পালা ঘড়িতে তখন বাজে সন্ধ্যা পাঁচটা, চারিদিকে অন্ধকার নেমে গেছে, পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখি এখনো দিনের আলো ফুটে আছে, যেদিন আমি মানুষের জন্য কিছু করতে পারব সেদিন আমার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নটা বাস্তবিক পূরণ হয়ে যাবে। মটরসাইকেলে চেপে আবার পথ ধরে ফিরতে ফিরতে অনুভব করতে থাকি ভীষন শুন্যতা, মনে অনেক প্রশ্ন উকিঁ মারতে থাকে, আমি আকাশ ছুতে পারলাম কিন্তু কবে এসব আদিবাসী মানুষের জন্য কিছু করতে পারবো? কবে মানুষের কষ্টে পাশে দাঁড়াতে পারবো? আমি যে আকাশটা ছোয়ার জন্য এই দূর্গম পথ পাড়ি দিয়েছি, সেই আকাশ কি আমি কোনদিন ছুটেঁ পারবো? নাকি আসার সময় যেমন অন্ধকার দেখে আসলাম সেই অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে এসব আদিবাসীদের জীবন…