“ভ্রমণকন্যা” পাঁচ অক্ষরের এই শব্দটি আজ আত্মার একটি অংশ, বাবা মায়ের পর পৃথিবীর ২য় প্রিয় শব্দ। মনে আছে সেদিন আমি হাসপাতালে ডিউটিতে। তখন সবেমাত্র ভ্রমণকন্যা ৬৪ জেলা ভ্রমণ সম্পূর্ন করেছে। ফেইসবুকের নিউজফিড ২ টা মেয়ের স্কুটিতে করে সারা বাংলাদেশ ভ্রমণের খবরে সয়লাব। মেয়ে দুটোর প্রাণবন্ত হাসি আমারও নজর কাড়ে। এরা কারা? কি দারুণ কাজটাই না করেছে। শুধু তারা দুইজন না। খেয়াল করে দেখলাম আরো কিছু মেয়েদের দলও আছে সাথে। মন ঠিক করলাম আমিও এদের সাথে কাজ করবো। খুঁজতে শুরু করি।খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম ভ্রমণকন্যা। কি দারুণ দারুণ কাজই না তারা করে চলেছে এতগুলো বছর ধরে। অথচ কিছুই জানি না! এক ঝাক মেয়ে নিয়ে ঘুরে আসছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। বন-জঙ্গল, নদী-সমুদ্র-পাহাড় অথবা বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ। কি দিন কি রাত। কিছুর বাদ নেই এই সাহসী মেয়েদের থেকে। কোনও মেয়ে হয়ত পরিবারের সাথেও, যেখানে যাওয়ার কথা ভাবেনি কখনও, সেখানেও সে ঘুরে এসেছে ভ্রমণকন্যার সাথে। অভিভূত হয়ে গেলাম আর ভ্রমণকন্যার প্রেমে পড়ে গেলাম। আমার জীবনের তৃতীয় প্রেম। তখন টাংগুয়ার হাওড়ের বুকিং চলছিল। সবকিছু মিলিয়ে বুকিং দিয়ে দিলাম। অচেনা অজানা ৩৫ জন মেয়ের সাথে পাড়ি দিলাম টাংগুয়ার হাওড়ের উদ্দেশ্যে। নিজের মধ্যে যে কি এক উত্তেজনা কাজ করতেছিল ভাষায় লিখে প্রকাশ করতে পারবো না। ভ্রমণের সময় একটাবারও মনে হয়নি তাদের সাথে এটা আমার প্রথম দেখা। অচেনা সবাই পরিবার হয়ে গেছি। কারো সাথে কারো মিল নেই, শুধু একটা মিল ভ্রমণের পিপাসা। ভ্রমণকন্যার সাথে প্রথম ভ্রমণ আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা অভিজ্ঞতা। আমি সাঁতার না জানা একটা মেয়ে, যাকে কেউ কখনও পানিতে নামতে দেয়নি ডুবে যাবে এই ভয় দেখিয়ে, যে শুধু নদীর পাড়ে পা ভিজিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে বয়ে যাওয়া নদী দেখে, যার স্বপ্নও সাহস করে না পানিতে নামার। সেই আমি হাওড়ের নীল পানিতে চোখ বন্ধ করে ভেসে থাকার এক অপূর্ব অনুভূতি পেয়েছি এবং এই অনুভূতি আমি মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত ভুলবো না। ছোটবেলায় কাগজের নৌকা পানিতে ভাসিয়ে দেয়ার মত, লাইফ জ্যাকেট পড়িয়ে আমাকে ভাসিয়ে দেয়ার আগমুহূর্তে, আমার কানে বলা ভ্রমণকন্যার সেই সাহসী কন্ঠের কথা “ভয় পেও না, শান্ত থাকো। দেখবে তুমি ভাসতেছো” আমি কখনও ভুলবো না। হ্যাঁ সাঁতার না জানা এই আমি প্রাণ ভরে মাঝ হাওরে ভেসেছি, গলা ছেড়ে রবি ঠাকুরের গান গেয়েছি। সেই কন্ঠ মনে করে প্রতিবার আমি পানিতে নামার সাহস পাই। সামনে পাহাড় নদীর এক অপূর্ব মিলন দৃশ্য আর পায়ের ওপর পা রেখে, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে হাওড়ের তাজা মাছের তরকারি দিয়ে পেট ভরে ভাত খাওয়ার স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে আছে। আহা! কি অমৃত! এই অমৃত আমি আর কোথায় পাবো? ঘুম থেকে উঠে মাত্র চোখটা খুললাম। চোখের সামনে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে সুবিশাল পাহাড়। তার মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। চেয়ে আছি তো চেয়ে আছি। ইশ্ এখানে এভাবেই যদি জীবনটা কেটে যেত! আর আমার জীবনে এই সবই সম্ভব হয়েছে শুধু শুধুইমাত্র ভ্রমণকন্যার জন্য। খোলা আকাশে চাঁদ আর তারার নিচে আড্ডা, মাঝরাতে গানের আসর, নীরব রাতে হাওড়ের পানির রহস্যময়ী শব্দ, বাংলাদেশে একটা মেয়ের জীবনে এই সময় বার বার আসে না।
তাই প্রতিটা মুহুর্তে বার বার মনে হচ্ছিল হাবিবের সেই গান
ধীরে ধীরে যাও না সময়,আরও ধীর বও
আরেকটুখণ রও না সময়, একটু পরে যাও
মানসী আর সাকিয়া খুবই ভাগ্যবতী যে তারা পরস্পর এমন বন্ধু পেয়েছে। আমি আজও খুঁজে চলি, কিন্তু এমন এক বন্ধু পেলাম না, চাঁদনী রাতে হাঁটতে ইচ্ছে করলে যে আমার ইচ্ছাকে আজব না বলে বলবে “বের হো, আমি আসতেছি।” শুধু তারাই জানে কতটা খারাপ লাগে যখন সাথী না পাওয়ায় তাদের ভ্রমনের কত ইচ্ছেঘুড়ি ভোকাট্টা হয় প্রতিদিনে । ভ্রমণকন্যার মাধ্যমে হাজারো মানসী তার সাকিয়াকে খুঁজে পেয়েছে। এখন ঘুরতে ইচ্ছে হলে কাউকে না পেয়ে হায় হুতাশ করতে হয় না। ভ্রমণের এক ডাকে আজ সাড়া দেয় কত মেয়ে। এই মেয়েরা আমার কাছে অন্য সবার থেকে আলাদা, আমার খুব প্রিয়, তারা যে আমার ভ্রমণের সাথী, আমার প্রিয় ভ্রমণকন্যা।
ডাঃ সুরভি ঘোষ