ভ্রম শব্দের আভিধানিক অর্থ ভুল, হিসেবে গোলমাল, ঘুরপাক। এদের মধ্যে ঘুরপাক আমার বেশি পছন্দের। ভ্রম যে ভুল তা আমি ছোটবেলা থেকেই মানতে নারাজ। কেন তাও বলছি একটু পর। ছোটবেলায় বিটিভিতে আযান দেখতাম যে কয়বার, প্রতিবারই মনে হতো, কি সুন্দর গম্বুজ! কি সুন্দর মসজিদ! কখনও যদি সামনাসামনি দেখতে পেতাম! বিজ্ঞাপন দেখতাম বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীর, কি সুন্দর সুন্দর জায়গায় ধারণ করা। মনে মনে ভাবতাম কবে দেখব, ঘুরব এমন জায়গা। সহপাঠীরা হাসত আর বলত খালি বড় বড় কথা! যেন ভ্রম আমার।
আরও একটু বড় হলাম। মা- বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলা ঘুরপাক করতে করতে স্কুল জীবন শেষ করার আগেই ৯টি স্কুল আর ২৭টির মত জেলা কখন ঘোরা হয়ে গেল বলতেই পারব না। এ যেন চোখ বন্ধ করে সম্মোহনী কোনো খেলা, মুহূর্তের মধ্যে পাড়ি দেয়া কোনও রঙিন স্বপ্ন! কুমিল্লার ময়নামতি, শালবন, বৌদ্ধবিহার থেকে শুরু করে দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, কক্সবাজারের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, বান্দরবন এর সবুজ পাহাড়ের সারি, টেকনাফের কাটা কাটা পাহাড়, তেঁতুলিয়ার চা বাগান, সিলেটের সাদা পাথর সবখানে ঘুরতে ঘুরতেই যেন ছোট্টবেলার সেই ভ্রম, মতিভ্রম হয়ে গেল এক ভ্রমণ পিপাসু কন্যার জীবনের লক্ষ্য। তবে জীবনের লক্ষ্য স্থির করলেই হয় না, ভাগ্যকেও সেই লক্ষ্যের সঙ্গী হতে হয়। আমার বেলায় সব পেয়েও তা পাওয়া হলো না।
মাধ্যমিক পরীক্ষার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সবচেয়ে বড় প্রেরণা, সব থেকে বড় বন্ধু, আমার ভ্রমণসঙ্গী- আমার আম্মুকে হারালাম। একসঙ্গে ঘুমোলাম, কিন্তু আমি একাই জাগলাম। শুরু হলো জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সাহসে বুক বেধে পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপ পার করলাম।
মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ব্যবসায় প্রশাসন এর উপর স্নাতক করতে ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশে পেলাম না কাউকে- না ভাই, না বাবা। কিন্তু পেলাম এক অমূল্য রতনকে। সবচেয়ে কঠিন সময়টাতে আল্লাহ্ যেন উপহার হিসেবে পাঠালেন তাকে। আমার জীবন সাথী, যাকে পেলামও আপন করে স্বামী হিসেবে দীর্ঘ আট বছরের আত্মার সম্পর্কের পরে। কিন্তু এতোগুলো বছর কাটলো অসম্ভব ধৈর্য পরীক্ষা আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে। ছাত্রজীবনে যে সময়টাতে আমার বন্ধুরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতো, মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবার খেতো, বাবার সাথে দুষ্টুমিতে মেতে থাকতো; সেই সময়টাতে আমার দুশ্চিন্তা কেমন করে চাল-ডাল কিনবো, সেমিস্টারের ফি দিব, বই-খাতা-ইউনিফর্ম কিনব অথবা মাসশেষে হোস্টেল ফি’ই বা কেমন করে আসবে। পুরোটা সময়ই সে আমার সহপাঠী, কখনও বা অভিভাবক হয়ে আমার সাথে ছিল। সে আমার সহযোদ্ধা। স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকেই টিউশনি, পরে চাকরি শুরু করলাম। কিন্তু হ্যাঁ, এতকিছুর মধ্যেও জীবনের প্রথম প্রেম ভ্রমণকে ভুলি নি আমি। স্নাতক শেষে একটু থিতু হয়ে আবার অল্প স্বল্প ঘোরাঘুরি শুরু।
ভ্রমণকে ভালবেসে বাংলাদেশ বিমানে চুক্তিভিত্তিক চাকরি নিলাম বিমানবালা হিসেবে। বেশ কয়েক মাস ভিসা ছাড়াই বিদেশ ঘুরে বেড়ালাম। উমরাহ করলাম। তাকে নিজেরও করে নিলাম। সাধ্যের মাঝে ধুমধাম করে বিয়ে করলাম। বিমানে চুক্তি শেষে আল্লাহ্ এর রহমতে একটা আমেরিকান এনজিও তে চাকরি শুরু করলাম।
আর এখন? শুধু ছুটি মিলিয়ে ঘোরাঘুরি। দেশ-বিদেশ সব। যতটুকু সাধ্যে মেলে! তবে একজন স্বপ্নপ্রেমী কন্যার জন্যে দেশের আনাচে কানাচে একা ঘুরে বেড়ানো যেমন প্রায় অসম্ভব, তেমনি অনিরাপদও বটে। ঠিক সময়ে ঠিক সঙ্গী-সাথী পাওয়াটাও কষ্টসাধ্য। আবার সঙ্গিনী যারা জুটে যেত, তাদের পরিবার থেকে আপত্তি থাকত যে “মেয়ে মানুষ একা একা ঘুরা! আস্তাগফিরুল্লাহ”। মেয়েরা তিন চারজন হলেও যেন একা, যতক্ষণ না পুরুষ সঙ্গী সাথে থাকছে। মন থেকে আওয়াজ আসত, যদি শুধু স্বপ্নবাজ আর ভ্রমনবিলাসী মেয়েদের একটা দল থাকতো! তবে হয়ত ঘুরে বেড়ানোর এই পাগলাটে চিন্তা গুলো সত্যি করা যেত। পূর্ণ হতো কত কত ঘুড়ি উড়ানো স্বপ্ন। তার কিছুদিন বাদেই এক সহকর্মীর কাছ থেকে ‘ভ্রমণকন্যা’র ব্যাপারে জানা আর তাদের দলে ভিড়ে যাওয়া। হ্যাঁ, আমার মনের আওয়াজেরই প্রতিধ্বনি যেন এই ‘ভ্রমণকন্যা’।
‘ভ্রমণকন্যা’র সাথে যুক্ত হয়ে আরও হাজার হাজার স্বপ্নবাজ ভ্রমণপ্রেমীদের পুষে রাখা স্বপ্ন পূরণ হতে দেখি এখন প্রতিনিয়ত। বেশ কিছু জেলা ঘোরা হল একসাথে।
সবকিছু মিলিয়ে- পরিবার, বন্ধু, স্বজন, নিজে নিজে ৫০টার মতন জেলা ঘুরেছি এখন পর্যন্ত আর ছয়টি ভিনদেশ। আমার স্বামী অসম্ভব সমর্থক আমার ঘোরাঘুরির, তা একা ঘুরি, অন্যদের সাথে হোক অথবা তাকে নিয়ে। সে বলে, তোমার চোখে পৃথিবী দেখি আমি। আর আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর সবাই অসম্ভব ভ্রমণপ্রিয়। প্রত্যেকেই খুব বেশি সমর্থন দেয় আমাকে। প্রত্যেকেই খুব বেশি সমর্থন দেয় আমাকে।
ছোট্টবেলার ভ্রম আজকে হলো ভ্রমণকন্যা। যে আজ মাথা উঁচু করে বলতে পারে যে টো-টো কোম্পানির ম্যানেজার হতেও যোগ্য, অধ্যবসায়ী আর পরিশ্রমী হতে হয়, সদিচ্ছা থাকতে হয়। যে জন্যে ভ্রমণকন্যা আজকে একটি ব্র্যান্ড।
লেখাঃ শাহ্নাজ রাফিয়া