You are currently viewing মিশন_হামহাম

মিশন_হামহাম

সপ্তাহ খানেক ধরে মাথায় ঢুকেছে হাম হাম এর নেশা। যদিও মেডিসিনে ইন্টার্ন হিসাবে জয়েন করার পর ঠিক করেছিলাম যাব না কোথাও। কিন্তু মন কি আর মানে?
ঠিকই প্লান করতে বসলাম বান্ধবী সাকিয়া হক এর সাথে। আর কেউ যাবে কিনা খোঁজ নিতে রোজার মধ্যেও কিভাবে কিভাবে যেন জুটে গেল আরো কিছু পাগলাটে মেয়ে। একজন তো খুলনা থেকে এসে জয়েন করল।
নির্ধারিত দিনে ফকিরাপুল বাস স্ট্যান্ড থেকে শ্যামলী বাসে উঠলাম আমরা ১৭ জন মেয়ে। গান গাইতে গাইতে বাসের লোকের ঘুমের বারোটা একটা বাজিয়ে ভোরে পৌঁছলাম শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ডে। আমাদের জন্য রাত ৩ টা থেকে অপেক্ষা করছিল জিপ গাড়ির দাদারা। সেখান থেকে সকালে নাস্তা করব পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টে। বলা ছিল আগের থেকে। আমাদের জন্য শুধুমাত্র খোলা রেখেছিল ভাগ্যিস। নইলে সেহরির পর নাকি বন্ধ করে দেয়।
খাওয়া দাওয়া করে উঠলাম জিপ গাড়িতে। দেখেই মনে হচ্ছিল রাজা গজাদের আমলের জিপ। রওনা দিলাম দুই গাড়িতে। আঁকাবাঁকা পথ, দুইপাশে সবুজ টিলা, এর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই সামনে চলে আসল চা বাগান। ছোট ছোট টিলাতে যেন কার্পেট বিছানো। এত সুন্দর সবুজ রঙ খুব কম দেখেছি। মনে হচ্ছে আর্টিস্ট এই মাত্র তাই তুলি দিয়ে জলরং করেছে, কিন্তু রঙ এখনো শুকায় নাই। শহরের অনভ্যস্ত চোখে এই সবুজ রঙ মাখতে কি আরামই যে লাগল। দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম কলাবন পাড়াতে। ওখান থেকেই আমরা গাইড নিয়ে ট্রেকিং শুরু করব। 
জিপ থামতেই নেমে রেডি হলাম জোঁকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাজ নিতে। নিচের প্যান্ট গুটিয়ে মোজার মধ্যে ভরে নিলাম। গাইড দাদারা নিয়ে আসলেন সাবান পানি। তাতে নাকি জোঁক দূরে থাকে। গুলও নেওয়ার কথা ছিল। দীনা আপু নিয়ে আসছিলেন ইনসেক্ট রিপেলেন্ট তাও মাখলাম। এই বর্ম পরে, হাতে লবনের অস্ত্র নিয়ে শুরু করলাম আমাদের হাঁটা। মনে শংকা, পারব তো? শুনেছি অনেক দূরূহ পথ। অনেকেই নাকি শেষ অবদি না যেয়ে ফিরে আসে। যাই হোক পোঁটলাপুটলি পিঠে নিয়ে হাঁটা ধরলাম। কিছুদূর যেতেই পর পর পাঁচটা সাঁকো। কোনোটায় হ্যান্ডেল আছে, কোনটায় নাই, একটায় আবার মাঝপথে কাঁপাকাঁপি শুরু করে। পার হয়ে লাইন ধরে এগোচ্ছি। সবার সামনে আর সবার পিছনে দুইজন গাইড দাদা,মিলন আর মঙ্গলদা। ভাবছি জোঁক ত দেখি না। লোকে মনে হয় বাড়িয়ে বলে। ওমা, কিছুদূর যেতেই জোঁকের দেখা মিলল। ছোট জোঁক, বড় জোঁক, টাইগার জোঁক, চিকন জোঁক আরো কত রকম রে বাবা। শুরু হলো ঢাল আর অস্ত্রের ব্যবহার। কয়েক মিনিট পর পর চিল্লানি জোঁক!জোঁক! সাথে সাথে যার হাতে লবন সে ছুটে যাচ্ছে। জোঁকের মুখে দিতেই সে কাত। চলতি পথে যে পিছনে সে সামনের জনের পায়ের দিকে খেয়াল রাখছে জোঁক ধরল কিনা। হাতের লাঠি মাটিতে ফেলবার আগে দেখে নিচ্ছে জোঁক আছে কিনা। এত কিছুর পরেও বিচ্ছুগুলো কিভাবে কিভাবে যেন আংগুলের ফাঁকে, জুতার ভিতরে এমনকি কপালেও হামলা করল। এরই মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি জংগল এর মধ্যে সরু রাস্তার মত জায়গা দিয়ে। দুইপাশে পাতা এসে গায়ে লাগছে। সেই পাতায় আবার দুই তিনটা করে জোঁকের বংশধর লাফাচ্ছে। কি যন্ত্রনা। দুইদন্ড দাঁড়িয়ে জল খাব তাও পারছি না। দাদারা বলল ১১ টা টিলা নাকি পার হতে হবে। হাঁটতে হাঁটতেই দুই ঢোক জল খেয়ে আবার পথ চলা।

ভাগ্যভাল দুই ঘন্টার মধ্যের গিরিপথ পার হয়ে নামলাম ঝিরি পথে। এখানে কষ্ট কম। তবে স্রোত আছে। গাইড ভাই বললেন বৃষ্টি হয়েছে, ভালো পানি পাওয়া যাবে। আকুলিবিকুলি মন, তাড়াতাড়ি পা চালালাম। আধাঘন্টা হাঁটলাম। শুনতে পাচ্ছি ঝর্ণার গর্জন। শেষ বাঁকে এসে থমকে গেলাম। মিনিট খানেক মুখে কথা নাই। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি এক অপরূপ দস্যির দিকে। কি ভয়ানক গতি নিয়ে, কি বিস্ময়কর ভঙ্গিমায় নেমে আসছে জলের ধারা। যেন কালবৈশাখী ঝড়ের মত উদ্দাম, বর্ষার পদ্মার মত ভয়ংকর রূপসী, যেন সত্যজিৎ এর দূর্গার মত চঞ্চল। বিশেষণের ভাণ্ডার যখন খালি হল এক পা দু পা করে এগোলাম এই রূপসীর কাছে। কাছে যেতেই বৃষ্টির পানির ছিটার মত সব ক্লান্তি যেন মুছে দিল। 
চার পাঁচ জন নয়, সতেরোটা মেয়ে আমরা শুধু হাম হাম এ সেদিন। চা ওয়ালা মামা ছাড়া আর কেউ নাই। হাম হামকে নিজেদের মত করে পেলাম। মন ভরে ভিজলাম। প্রাণ ভরে দেখলাম।আর ছবির বাক্স ভরে ছবি তুললাম। সতেরটা মেয়ে পাশে পাশি দাঁড়ালাম যখন বুকের ভিতর থেকে যেন বেরিয়ে আসল ‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। ‘ গায়ের লোম গুলো যেন কি যেন এক শিহরণে দাঁড়িয়ে গেল। 
মনে দুষ্টুমি জাগল। ব্যাগে করে চুপিসারে এনেছি এক সবুজ শাড়ি। বাঙ্গালি মেয়ে লোভ সামলাতে না পেরে পরেই ফেললাম। একের পর একজন শাড়িটা পরে ইচ্ছাপূরণ করল।।
এবার ফেরার পালা। মন চাইছে না ফিরি। কিন্তু ইট কাঠের এই শহরব ফিরতে যে হবেই। মুগ্ধতা নিয়ে বিদায় জানালাম। একবুক ভরা স্মৃতি নিয়ে রওনা দিলাম ফেরার পথে।

যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল : বাসে (৩৮০ টাকা ভাড়া শ্যামলী নন এসি)
বাসস্ট্যান্ড থেকে কলাবন পাড়া: জীপগাড়ি (৩০০০-৩৫০০ টাকা)। সিএনজিতেও যাওয়া যায়। 
কলাবন পাড়া থেকেই গাইড নিয়ে নেওয়া যায়। ৪০০ টাকা করে নেয়।

ডাঃ মানসী সাহা তুলি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

Leave a Reply