১৭ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন। প্রতি জন্মদিনে দেশেই থাকি। এবার একটু অন্য রকম জন্মদিন পালন করবো বলে দুবোন আমি ও বুশরা মিলে কলকাতা রওনা হলাম।
১৪ ডিসেম্বর কলকাতা রওনা হয়ে ১৫ তারিখ কলকাতায় থেকে পরদিন ১৬ ডিসেম্বর হাওরা থেকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চেপে দুপুর নাগাদ বোলপুর স্টেশন পৌঁছে যাই। বোলপুর নেমেই বুঝতে পারি এখানে চারিপাশে প্রকৃতির খেলা। এখানে অনেক ভালো ও সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট ও বাংলো থাকলেও আমরা টোটোতে চেপে বিশ মিনিটে চলে আসি যে বাংলোতে তার নাম প্রকৃতি বাংলো। আমার দেশের ব্যাটারিচালিত অটো রিকসাকে এখানে টোটো বলা হয়।বাংলোর নামই প্রকৃতিবাংলো আর আমাদের টোটো ড্রাইভারের নাম লাল্টু। লাল্টুর টোটোতে চেপে শহরের শেষ প্রান্তে বনবাংলোতে পৌঁছে মনটা আনন্দে নেচে উঠল।শহর থেকে এসে এমন প্রকৃতির কোলে যে কোনো মানুষের মনে আনন্দ হবেই। প্রকৃতি বনবাংলোতে মোট চারটা কটেজ প্রতিটি ডুপ্লেক্স। ডুপ্লেক্স কটেজের দোতলায় রুম দুটি করে।আমাদের থাকার কটেজেরে রুম দুটির নাম ছিল রাধাচুরা ও কৃষ্ণচূড়া। আমরা ছিলাম কৃষ্ণচূড়াতে।

চমৎকার ঘর, এটাচ বাথ, সামনের খোলা প্রান্তর দেখার জন্য বারান্দা। আমাদের কটেজের পাশে ছোটো একটা কটেজে কেয়ারটেকার সস্ত্রীক থাকেন, খাবারের ব্যবস্থা তারাই করে দেন। আর ছিল গাড়ি রাখার গ্যারাজ। উন্মুক্ত প্রান্তের মাঝে মাঝে কেয়ারি করা ফুলের গাছ,নানা রকম ক্যাকটাসও আছে তাতেও ফুলের সমারহ। আমরা এসেছি শীতের শুরুতে কিন্তু নিম্নচাপের জন্য বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, আর কী যে ঠান্ডা! বনবাংলোর চারিপাশে পাখির কিচিরমিচির মিলে সব কিছু অসাধারণ। অর্ডার না হলে রান্না করেন না কেয়ারটেকার। আগে থেকে বলে রাখতে হয়। সেজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম এই বেলা বাইরে খাবো। দ্রুত ফ্রেস হয়ে বের হয়ে পড়ি লাল্টুর টোটোতে। এরমধ্যে কেয়ারটেকার লাল্টুর সঙ্গে আমাদের ভাড়ার মিটমাট করে দিয়েছেন। আজ আধাবেলা ও পরদিন সারাদিন শান্তিনিকেতন দেখাবে সে আমাদের ভাড়া ঠিক হয় আটশটাকা। আমরা দ্রুত তৈরী হয়ে লাল্টুর টোটোতে চেপে খাবার রেষ্টুরেন্টে চলে আসি। এটা একটা রিসোর্ট নাম রামশ্যাম। পাশেই ওদের রেস্টুরেন্ট। আমরা দেড়দিন ছিলাম। এই রামশ্যামে তিনবেলা খেয়েছি। আর দুইরাত কেয়ারটেকারের হাতের রান্না। সেদিন রামশ্যামে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে আসি খোয়াইঘাট। সেদিনের মত আমাদের বেড়ানো ছিল খোয়াইঘাট ও খোয়াইঘাটের অন্যহাটের কেনাকাটা। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বনবিভাগ এখানে রাস্তার সব আলো অফ করে দেন। সুতরাং আমরা আগে ভাগেই বনবাংলোর পথ ধরি। কয়েকদিন টানা ভ্রমণে খুব ক্লান্ত ছিলাম। রুমে ফিরে খেয়েদেয়ে তাই ঘুমাতে সময় লাগে না। ভুলে যাই রাত ১২টা পেরুলে আমার জন্মদিন!
ঘুম ভাঙ্গে সকালবেলা জন্মদিনের শুভেচ্ছায়। কথা বলতে বলতে রাধাচূড়ার বারান্দায় আসি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ও শীতের দিনেও সবুজ প্রকৃতি বন উদাস করে তোলে। এরমধ্যে লাল্টুর ফোন। আমরা দ্রুত তৈরী হয়ে বের হই। আজ আমাদের শান্তিনিকেতনের দিন!

শুরুত আমরা চলে যাই কংকালিপাড়া। কালিমায়ের কংকাল পড়েছিল এখানে, সে জন্য এর নাম হয়েছে কংকালিপাড়া। কংকালিপাড়া থেকে আমরা চলে যাই শান্তিনিকেতনের গা ঘেঁসে বয়ে চলা কোপাইনদীর তীরে। কবিগুরু তার চিত্রবিচিত্র কাব্যে আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে লিখেছিলেন। কে জানে তিনি কোপাইনদীর সৌন্দর্য বর্ণনায় কবিতাটি লিখেছিলেন কিনা। কোপাই তেমন বিশাল নদী না। আমরা তবু অনেকটা সময় কোপাইর তীরের সময় কাটানোর পর প্রান্তিকে চলে এসে নাস্তা করি। তারপর ঘুরে দেখি পুরো শান্তিনিকেতন, স্বপ্নপূরণ বলা যায়।আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি কাচ মন্দির, বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস, উত্তরায়ণসহ কবিগুরুর নির্মিত পাঁচটি ঘর; উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ ও উদীচি । দুপুর বারোটায় মিউজিয়ামে গিয়ে বন্ধ পাই। দুইটার পর খুলবে। সে সময়টুকু আমরা দেখে আসি সৃজনী। তারপর রামশ্যাম রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে মিউজিয়াম দেখি। দেখি বাংলাদেশ ভবন। শান্তি নিকেতনে বাংলাদেশ নামের ভবনটি আমাদের গর্ব।


বাংলাদেশ ভবনের প্রধান সমন্বয়কারি মানবেন্দ্র দা আমার র্পূব পরিচিত। তিনি আবার বিশ্বভারতিতে বাংলা পড়ান। দাদা আমায় ঘুড়িয়ে দেখান পুরো বাংলাদেশ ভবন।

সেখান থেকে চলে আসি খোলামাঠের হাটে। এখানে দুটো হাট বসে। একটা ছোট ও আরেকটা বড়হাট। হাটে বিক্রি হয় বেশীরভাগ হস্ত শিল্পসামগ্রী। সে জন্য এই হাটকে হাট না বলে হস্ত শিল্প প্রদর্শনীও বলা যায়।

আগেই বলেছি বনবিভাগ এখানে রাস্তার আলো সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে অফ করে দেন। হাটবাজারও সে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। আমরা শান্তিনিকেতনকে বিদায় বলে চলে আসি আমাদের বাংলোতে, তার আগে অবশ্য কেনাকাটার জন্য আমারকুটিরে ঢুঁ মারি।
শেষকথা-সারাদিন টুপটাপ বৃষ্টি ছিলো,সন্ধ্যায় রুমে ফিরে দেখি বিদ্যুত নেই,ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করাতেই বাংলোর ম্যানেজার বললো ,লোডশেডিং এ তার ছিড়ে গেছে ম্যাডাম,আজ রাতে আর ঠিক করা সম্ভব হবেনা।কাল সকালে করে দিবো।এই বলে ২ টা বিশাল আকারের মোম হাতে ধরিয়ে দিলেন।রাতে খাওয়া দাওয়া সব কিছু মোমের আলোতেই করতে হল। যাক,একটা বিষয় মজার ছিলো ,মানুষ শখ করে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করে,আর আমরা বাধ্য হয়ে করেছি,ব্যাপারটা মজারই ছিলো। শান্তিনিকেতনটা আসলে শান্তিরজায়গা। হইহুল্লুড় নাই, বাস-গাড়ীর শব্দ নাই।মানুষজন গুলো কেমনচুপচাপ । ৬টা বাজতে না বাজতেই সব আরো নিশ্চুপ। আমরা দুইবোনও খেয়েদেয়ে ঘুম।এই হলো আমার ২০১৮ এর জন্মদিন ও প্রিয় শান্তি নিকেতন দেখা!সামনে বসন্তোৎসব।আপনিও ঘুরে আসতে পারেন।

এখানে থাকার অনেক ভালো ভালো বাংলো ও রিসোর্ট আছে। উৎসব ছাড়া আগে থেকে বুকিং দিতে হয় না। তবে শান্তি নিকেতন এক্সপ্রেসের টিকিট আগে থেকেই কাটতে হয়। দুইদিন হাতে নিয়ে গেলে শান্তি নিকেতনের সবই আরামসে দেখে আসবেন।
হাদিরাতুল তালুকদার