You are currently viewing সঙ্গোপনে মেঘের আলিঙ্গনে

সঙ্গোপনে মেঘের আলিঙ্গনে

আকাশের সাথে পরিচয় তারপর মেঘের সাথে প্রেম সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা; আর এ অনুভূতি ব্যক্ত করতে হলে ছোট্ট বেলার স্মৃতি স্মরণ করতে হবে। আমার ভাই বোনদের মধ্যে আমার উপরে যে সে ও ভাই আর নিচে যে সে ও ভাই। আমিও তাই ছেলে সেজে ওদের দলে ভীড়ে মাঠে ময়দানে ছেলের সব খেলা খেলতাম আর দুরন্তপনায় দিন কাটাতাম। তবে ক্লাশ সিক্স এ উঠে হঠাৎ যখন ছিপছিপে লম্বা হয়ে গেলাম, ওমনি আমার পায়ে শিকল পড়ল। নিষেধাজ্ঞা জারী হলো ভাইদের সাথে আর ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাইরে যাওয়া যাবে না। আমি তখন শিকল ভাঙ্গার গান না ধরে লক্ষী মেয়ের মত মায়ের আঁচল ধরে এ ঘর ও ঘর করে, কখন বা ছাদে উঠে বিকাল দেখে দিনাতিপাত করতে শুরু করলাম। বাসার ছাদে উঠে বিকাল দেখি, পাখি দেখি,সবুজ দেখি,আকাশ দেখি; দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে আকাশের সাথে সখ্যতা হয়ে গেল খুব।আকাশের বিশাল বুকে কল্পনার ডানায় ভাসতে ভাসতে আলাপ হল মেঘের সাথে। আকাশ-মেঘের খেলায় মেতে, দূর দিগন্তে ভেসে যেতে যে কি শুভ্র অনুভূতি অনুভব হত! তখন থেকে আমার প্রেমে পড়া…


“যখন মেঘের প্রেমে আকাশ ফ্রেমে বাঁধা পরে উদাসী এই মন।
তখন থেকেই মেঘই আমার একান্ত সেই প্রিয়জন।
তখন থেকেই আমার মন পরে রয় এই আকাশে, একবার, শুধু একবার এই মেঘ স্পর্শের অভিলাষে।”


এত:পর বিয়ে হল আমার, নাহ্ মেঘের সাথে নয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ কর্মরত একজনের সাথে। তাতে অবশ্য আমার প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটেনি বরং আমার প্রেম খুঁজে পায় এক নতুন দিগন্ত। এতকাল আমি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে দেখা মেঘের রূপ বৈচিত্রে বিভোর থাকতাম আর এখন সদা প্লেনে চলাচলের সুযোগ হওয়ায় মেঘের বুক ফুঁড়ে ছুটে চলার চঞ্চলতায় বিহ্বল থাকি। মেঘের উপরে উঠে, উপর থেকে দেখা মেঘের মোহময়তায় নিমগ্ন থাকি। মেঘের সাথে ভেসে চলার আবেগে আপ্লুত থাকি। আর মনে মনে মেঘ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন সাজিয়ে রাখি। এরপর দেশ-বিদেশ ভ্রমণের তালিকায় এলো মালয়েশিয়ার “গেন্টিং আইল্যান্ড”, ২০০৯ সালে পাড়ি জমালাম সেথা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে যাওয়ার লক্ষ্যে কুয়ালালামপুর থেকে বাসে করে রওনা হলাম “গেন্টিং আইল্যান্ড” এর উদ্দেশ্যে। বিস্তীর্ণ “পাম ট্রি” বন এর ঘন সবুজ আমার নজর কেড়ে নিল সারাটা পথ। এরপর গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের বাসটি যেন সুউচ্চ পাহাড়কে সাপের মত করে পেচিঁয়ে ধরে কেবল উপরের দিকে উঠতেই থাকলো উঠতেই থাকলো, সে এক অন্য রকম অনুভূতি! আমরা গেন্টিং আইল্যান্ড এর “ফাস্ট ওয়ার্ল্ড হোটেল” এ উঠে ছিলাম। এই “ফাস্ট ওয়ার্ল্ড হোটেল” টি বাহ্যিক দিক দিয়ে আমার দেখা সবচেয়ে কালার ফুল একটি হোটেল। হোটেলটি দেখে মনে হয় কোন এক শিশু যেন তার “স্বপ্নের দালান” টি এঁকে মনের খুশিতে ইচ্ছে মতো রং করেছে। ডিসেম্বরে খ্রীষ্ট ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘ক্রিস্টমাস’ উদযাপনের আয়োজনে জমকালো সাজে সজ্জিত এ হোটেলে প্রবেশ করেই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে আমি বিস্ময়কর উত্তেজনা বোধ করলাম। মনে হচ্ছিল এশিয়ার নয় বরং পাশ্চাত্যের কোন লোভনীয় দেশে আমার অনুপ্রবেশ ঘটলো বোধ হয় ! তবে এর চেয়েও বিস্ময়কর ‘বিস্ময়’ অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। সুউচ্চ এই হোটেলের উচ্চতর একটি কক্ষে আমরা প্রবেশ করলাম। সুসজ্জিত এয়ারকন্ডিশন রুম; কিন্তু এয়ারকন্ডিশন এর শীতলতায় স্বস্তি পেলাম না আমি। কেন জানি জানালা খোলার জন্য অস্থিরতা বোধ করলাম এবং অদ্ভুত এক টানে আমি ধীরে ধীরে জানালার কাছে এগিয় গিয়ে সম্পূর্ণভাবে জানালাটা খুলে ধরলাম।আর তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে সযত্নে সাজিয়ে রাখা জীবনের সেই স্বপ্নটা সত্য হয়ে উঠলো। হ্যাঁ এক গুচ্ছ শুভ্র সতেজ মেঘ হুরমুড়িয়ে জানালা দিয়ে আমার কক্ষে ঢুকে পড়ল এবং অবলীলায় সাবলীলভাবে আমায় আলিঙ্গন করে বসল, যেন আমারই প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান ছিল। আমি শুধু আবেগে ভাষাহীন, হতবাক এক প্রেয়সীর মত নিঃশ্বব্দে আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসাকে আলতো করে স্পর্শ করে রইলাম অনুভবে। আর হিসাব মেলালাম আমার কতটা কাল গেছে দূর থেকে এই মেঘ দেখতে দেখতে আর আজ সেই মেঘ আমায় দেখতে এলো! সার্থক আমার প্রতিক্ষা, সার্থক আমার ভালবাসা! মালয়েশিয়া ভ্রমন শেষে পরম প্রাপ্তির সুখ বুকে নিয়ে দেশে ফিরে এলাম। কর্মব্যস্ত জীবনের যান্ত্রিক ছন্দে আবারও শুরু হলো পথ চলা।

তবে মনে মনে থাকে “গেন্টিং আইল্যান্ড” এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের ও মেঘ স্পর্শের সেই অভাবনীয় অনুভূতির স্মৃতিরোমন্থন। এর মাঝে বাংলাদেশের কোন এক টিভি চ্যানেলের ‘পর্যটন’ বিষয়ক অনুষ্ঠানে জানতে পারলাম আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের উঁচু পাহাড়ী এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির বসতী আছে। যাদের গৃহে নিত্য মেঘেদের আনাগোনা, যাদের ঘুম ভাঙ্গে মেঘের আলিঙ্গনে, যাদের কাছে গোধূলী আসে মেঘের ডানায় ভেসে! তবে সেখানে পৌঁছাতে হলে আমাদেরকে ম্যালেরিয়া নিরোধক ঔষধ গ্রহণ করে, নিজ হাতে কাস্তে দিয়ে পথের লতা গুল্ম ও কন্টকযুক্ত বুনো গাছ কেটে পথ বানিয়ে তবে এগোতে হবে। এটা জানার পর থেকে এক ধরনের আপসোস হৃদয়ে দানা বেঁধে আছে যে, পরদেশী মেঘের আলিঙ্গনের আবেশে আবদ্ধ হয়ে আছি কিন্তু নিজ দেশের মেঘের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আজো হয়নি। তবে এখন আশাবাদী যে “ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ” এর ভ্রমন কন্যাদের ছন্দদৃপ্ত দুরন্ত পদচারনায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযমন্ডিত প্রতিটি প্রত্যন্ত প্রান্তর প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।‘ ভ্রমন কন্যা’দের হাত ধরে মানুষ মেঘের বাড়ি বেড়াতে যাবে।

রাজিয়া এ্যানী
উপপরিচালক (বোর্ড, জনসংযোগ ও প্রটোকল)
রাজউক,ঢাকা।

Leave a Reply