হামতা পাস,,, হিমালয় পর্বতমমালার পীর পাঞ্জল রেঞ্জের ৪২৭০ মিটার (১৪১০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এটি ভারতের হিমাচল প্রদেশের লাহৌল ও কুল্লু উপত্যকায় পরেছে।এটি মূলত হামতা নামক একটি গ্রাম যা শেঠভীলেজের নীচে অবস্থিত এর নামেই নাম করণ করা হয়েছে।
গ্রীষ্মকালে যখন লাহোর শুষ্ক মরুভূমিতেতে রুপ নেয় তখন এখানকার মেষপালকেরা সবুজ ও উন্নত ঘাসের সন্ধানে হিমালয়ের এই রেঞ্জগুলোর হ্রদগুলো ব্যাবহার করে থাকে।
এখানে প্রায় ৩০০০-৩৮০০ মিটার পর্যন্ত বিভিন্ন চোখজুড়ানো বন্য ফুলের দেখা মিলে,, এছাড়াও উলম্ব শিলা পাথর, হিমবাহ,, ছোট ছোট হ্রদ, ৬০০০ মিটার পর্যন্ত উপরে উঠে যাওয়া পর্বত এই ট্রেকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পাহাড় আমি ভালোবাসি,,, কিন্তু সেটা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে, এই ব্যাপারটা আমার কাছে একটু স্বপ্নের মতই ছিলো। ছোট বেলা থেকেই ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু একজন নারী হয়ে দেশের মধ্যে ঘুরাঘুরি করাটাই যেখানে দু:সাধ্য ব্যাপার সেখানে দেশের বাইরে তো ভাবাই যায় না। তাও আবার আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য। দেশের মাটিতে ঘুরাঘুরি শুরু করি ২০১৬ সালের প্রথম দিক থেকে।আর আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকি ভ্রমণ পাগল বেশ কিছু সুন্দর মনের মানুষের সাথে। তাদের মধ্যেই একজন হলেন শামীম ভাই। হঠাৎ একদিন উনি বলে বসলেন,, তুমি তো বেশ ভালই ঘুরো,, চলো তোমাকে হিমালয় দেখিয়ে নিয়ে আসি।আমিও আগপিছ না ভেবে রাজি হয়ে যাই। গল্পের শুরুটা এখান থেকেই। এভাবের গন্তব্য হিমাচল প্রদেশের হামপতা পাস এবং স্পিতির চন্দ্রাতাল লেক।
এরপর শুরু হলো পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এর কাজ। একে একে যখন সব কিছু আমার হাতে এলো তখন শুধু দিন গুনছিলাম। ঈদের পরদিন রাতে ১১ জনের টিম রওনা দিয়ে প্রথমে বর্ডার এ ইমিগ্রেশানের কাজ সেরে কলকাতা পৌছাই এরপর দিল্লী,, দিল্লী থেকে বাসে মানালীর উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
মানালী যাবার পথে খুব ভোর বেলা ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ জুড়িয়ে গেলো সবুজ পাহাড় আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলা দেখে। দেখতে দেখতে কখন মানালী পৌছে গেলাম খেয়ালই করি নি।মানালী নেমে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা খাওয়ার পর আমাদের টিম লিডার পরিচয় করিয়ে দিলেন ট্রেক লিডারের সাথে। তখন থেকেই কেমন একটা এডভেঞ্চারের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। ট্রেক লিডার এর নির্দেশনায় আমরা ২ টি জীপে করে ১১ জনের টিমটি পৌছে যাই জুবরা নামক একটা জায়গায়। আঁকাবাঁকা পাহাড়ের বুক ছেড়া রাস্তা দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন যতই নিচের দিকে তাকাই ততই মনে হচ্ছিলো পাহাড় বেয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছি। আর রাস্তার দুপাশের আপেল গাছ দেখে পেট ভরে যাচ্ছিলো। জুবরা থেকেই শুরু হয় আমাদের ট্রেকিং পার্ট। প্রায় দুই ঘন্টা হাটার পর আমরা চিকায় গিয়ে পৌছাই। সেইদিন ছিলো আমাদের ক্যাম্পিং এর প্রথম দিন। জায়গাটা প্রথম দেখার পর আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আর এক পাশের পাহাড়ের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে শীতল ঝর্ণাধারা। এক কথায় মনে হচ্ছিলো আমি যেনো কোন গল্পের বইয়ে ডুকে গেছি যেখানে লেখক তার মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতির রুপ একেঁ দিচ্ছে।
এরই মধ্যে টিমের বাকি মেম্বারদের সাথে একটা ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরদিন সকাল বেলা নাস্তা সেরে ট্রেক লিডার ও টিম লিডারের মটিভেশনাল ব্রিফিং শুনে রওনা হই বালুকা ঘেরার উদ্দেশ্যে। আমি তখনো জানতাম না যে সামনে আমার জন্য আরো বড় বড় চমক অপেক্ষা করছে। বালুকা ঘেরা পৌছাতে সেদিন আয়ামাদের প্রায় পাচঁ ঘন্টা ট্রেকিং করতে হয়েছিলো। ক্যাম্প সাইডের কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়লো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ডিও তিব্বা আর আরো কিছু নামহীন কিছু পিকের দিকে। পাহাড়ের চূড়াগুলো বরফে ঢাকা ছিলো তার মাঝে শেষ বিকেলের রোদ পরে একটা সোনালী আভা তৈরি করলো। সাদা বরফ আর সোনালী আভায় যে মায়াবী সৌন্দর্য আমি অবলোকন করেছি সেটা কিছু মুহূর্তের জন্য নিজেকে ভুলিয়ে দিতে বাধ্য করলো। ভেতরে ভেতরে তখন ঐ চূড়ায় যাওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা আর প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। যেনো মনে হচ্ছিলো আমার পিছনে আর কিছু নেই যা আছে সব অই চূড়ায়। পরদিন ছিলো আমাদের ট্রেকিং এর সবচেয়ে অগুরুত্বপূর্ণ দিন। ট্রেক এর পূর্বেই শামীম ভাই আমাদের জানিয়ে দিলো আমরা আজকে ১৪১০০ ফিট উপরে উঠতে যাচ্ছি এবং প্রায় আট / দশ ঘন্টা ট্রেকিং করতে হবে। শুনেই মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছিলাম কিন্তু তার থেকে বেশী রোমাঞ্চিত হয়েছি। সাত ঘন্টা ট্রেকিং শেষে যখন স্বপ্নের সেই হামপতা পাসে পৌছালাম তখন পিছে ফেলে আসা কষ্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম,, বৃষ্টিতে ভেজা,, বরফ
ঠান্ডা পানিতে নদী পার হওয়া,, চোখের সামনে এভালেন্স এবং তার বিকট ভয়ংকর শব্দ,, স্নোফল উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। সবকিছুই যেনো কল্পনা মনে হচ্ছিলো। রাতের সৌন্দর্যটা ছিলো আরো মায়াজালে ভরপুর। রাতের আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা আর গ্যালাক্সীর দেখা পাওয়াটা ছিলো সবচেয়ে বড় উপহার। এমন রাতে কি একটু গান বাজনা না হলে চলে…?? তাই সব্বাই মিলে ঠান্ডা উপেক্ষা করেই গানের আড্ডাতে মেতে উঠলাম। কিন্তু তখনো আমি ভাবিনি যে, আমার জন্য আরো বড় একটি চমক অপেক্ষা করছে চন্দ্রাতালে। ছোট ট্যুরিস্ট বাসে করে প্রায় তিন ঘন্টা ভয়ংকর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে জার্ণি করার পর পৌছালাম চন্দ্রাতাল লেকে। রাস্তাটা ভয়ংকর হলেও জার্নিটা অসাধারণ ছিলো। গাড়ি থেকে নামার পর পনেরো মিনিটের হাটার পথটুকু মনে হচ্ছিলো শেষই হচ্ছে না। কিন্তু একটু এগোতেই লেকটা দূর থেকেই তার অপরুপ সৌন্দর্যের আভাস দিচ্ছিলো।
মুহুর্তের মধ্যেই লেকের ঠান্ডা জলরাশি আর বাতাস মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলো আমাকে। কিছু সময়ের জন্য বোবা হয়ে বসে রইলাম। আর আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম তার এমন সুন্দর একটি সৃষ্টি নিজ চোখে দেখতে পাওয়ার আনন্দে। দেখতে দেখতে আমাদের ট্যুর প্রায় শেষের দিকে তখন বাড়ি ফেরার পালা। আমার বেশ মন খারাপ হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুই করার নেই নিজ দেশে তো ফিরতেই হবে। সন্ধ্যায় বাস ধরতে হবে,, আমাদের গাড়ি মানালীর উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলছে আর আমি ফেলে রেখে এলাম আমার ভালোবাসা,, আমার পাহাড়ি ভালোবাসা
রোমানা রশীদ তন্দ্রা
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার